মিয়ানমার ত্রাণ বন্ধের প্রস্তাব দিলেও মানবিক কারণে মানছে না বাংলাদেশ

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2018.08.29
ঘুমধুম (বান্দরবান)
   বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু খাল ঘেঁষা কোনারপাড়া শূণ্যরেখায় এক বছর ধরে আটকে আছে রোহিঙ্গারা। কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশের পাহাড়ের ছাউনি থেকে তাদের ওপর নজর রাখছে মিয়ানমারের বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ)। ২৭ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ।

বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া নো-ম্যানস ল্যান্ডে আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মিয়ানমারের দেওয়া শর্ত মেনে নেয়নি বাংলাদেশ। এখনো সেখানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফরের সময় গত ১০ আগস্ট দেশটির পক্ষ থেকে শূন্যরেখায় ত্রাণ বন্ধের প্রস্তাব দেওয়া হয়। মিয়ানমার সেখানে অবস্থানরত লোকজনকে দেশটির মানবিক সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করার প্রস্তাব দেয়।

বাংলাদেশ এই প্রস্তাব মেনে নিলেও শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এতে আপত্তি জানায়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. আবুল কালাম মঙ্গলবার দুপুরে বেনারকে বলেন, “এ বিষয়ে সরকার এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। যে কারণে ​শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গারা এখনো ত্রাণ পাচ্ছে।”

“মিয়ানমার অনেক কিছুই চাইতে বা বলতে পারে। কিন্তু আমরা সরকারি সিদ্ধান্তে বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না,” বলেন আবুল কালাম।

এর আগে বাংলাদেশের সঙ্গে এক বৈঠকে মিয়ানমার নিঃশর্তভাবে শূন্যরেখায় আটকে থাকা এই রোহিঙ্গাদের উত্তর রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল। বৈঠকের এক দিন পরই মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় দৈনিক ‘দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার’ এ কথা জানায়। সেই উদ্যোগও কার্যকর হয়নি।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট এশিয়া সেন্টার এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এমন একটি সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশকে বোঝাপড়া করতে হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে খুবই চ্যালেঞ্জিং। এটা সহজেই বোঝা যায় যে, মিয়ানমার বাংলাদেশকে ক্রমাগত অসহযোগিতা করে যাচ্ছে।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “মূলত মানবিক কারণে মিয়ানমারের ত্রাণ বন্ধের আবদার মানা হয়নি।”

মংডু শহরের আদি বাসিন্দা মোহম্মদ ফারুক (৪৪) বর্তমানে ২১ সদস্যের বড় পরিবার নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের শূণ্যরেখায় বাস করছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার খাদ্য নিতে মানা করলেও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের কথা ভেবেছে। তারা ত্রাণ দিয়ে এই অত্যাচারিত মানুষগুলোকে রক্ষা করছে।”

এতগুলো মানুষ খাদ্য না পেলে কীভাবে বাঁচবে—এমন প্রশ্ন রেখে ফারুক বলেন, “মিয়ানমার আমাদের ফিরিয়ে নিতে নয়, আরও কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন শর্ত দিয়েছে। এ জন্য আমরা তাদের ধিক্কার জানাই।”

আরআরসি আবুল কালাম জানান, জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) আওতায় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস (আইসিআরসি) প্রতি মাসে দু’বার করে নো-ম্যানস ল্যান্ডে ত্রাণ দিচ্ছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইসচিআর) প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী তমব্রু খালের কাছে শূন্যরেখায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা পরিবারের নারী, পুরুষ, শিশু অবস্থান করছিল।

তবে এখানকার রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ (৫২) বেনারকে জানান, বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) গুলিবর্ষণের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে তিনশ পরিবারের প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা পালিয়েছে।

এদের কেউ কেউ উখিয়ায় ক্যাম্পে গেছে—এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, এখন হাজারখানেক পরিবারের সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষে এখানে আছে।

সর্বশেষ গত জুনে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে বিজিপি। এতে আনসার উল্লাহ নামে ১১ বছরের এক শিশু ফুটবল খেলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। সে এখনও হাসপাতালে আছে বলে জানান ফারুক।

শূন্যরেখার বাসিন্দা হাফেজ ওমর সুলতান (৭৫), ঈমান শরীফ (৫০), মোহাম্মদ হারুন (৪৫) এবং মোহাম্মদ জোবায়ের (৩০) জানান, বিজিপির সদস্যরা প্রায় প্রতি রাতে মাইক দিয়ে আমাদের গালাগাল করে। মাঝে মাঝে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে।

শূন্যরেখায় হেড মাঝির দায়িত্বে থাকা দিল বেনারকে বলেন, “তারা প্রতিদিন মাইকিং করে আমাদের এখান থেকে সরে যেতে বলে।”

“তারা বলে তোমাদের এই অবস্থান অবৈধ। তোমাদের আইন মানতে হবে। এখান থেকে চলে যাও। কিন্তু আমরা কোথায় যাব, এটা তারা বলে না,” জানান দিল মোহাম্মদ।

এই রোহিঙ্গা নেতার আদি বাড়ি সীমান্ত থেকে মাত্র ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের ভেতরে।

দিল আরও বলেন, “এখানে যারা আছে, তাদের বেশির ভাগ সীমান্তের আশপাশের গ্রামের মানুষ। মাত্র দুই-তিনটি পরিবার আছে যারা অনেক দূর থেকে এসেছে।”

দূর থেকে আসা একটি পরিবারের প্রধান হাফেজ ওমর সুলতান। মংডু শহরের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন সুলতান। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও অত্যাচারের মুখে ২৫ আগস্টের পর তারা সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হন। টানা সাত দিন হেঁটে সীমান্ত পার হওয়ার পর এখানে অবরুদ্ধ হয়।

সুলতানেরই ছেলে ফারুক বেনারকে বলেন, “আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানকার সবগুলো ঘর-বাড়ি তারা ধ্বংস করে দেয়।”

তাদের পাড়ার ১৩ হাজার ৮১৩ জন রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র এক হাজার ২৭৩ জন জীবন বাঁচাতে পেরেছেন বলেও উল্লেখ করেন ফারুক।

গত সোমবার সরেজমিনে কোনাপাড়ার শূন্যরেখায় গিয়ে দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার পাশেই একটি নতুন ছাউনি তৈরি করছে বিজিপির সদস্যরা। পাশের ছাউনিতে থাকা এক বিজিপি সদস্য রোহিঙ্গা জমায়েতের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। তার পাশের আরেকজনের চোখে ‘বাইনোকুলার’।

রোহিঙ্গারা জানান, বিজিপি সব সময়ই তাদের নজরদারির মধ্যে রেখেছে। সেখানে দায়িত্বরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি তারা।

এই সীমান্তে বিজিপির অতিরিক্ত তৎপরতা প্রসঙ্গে মিয়ানমার সরকারের এক মুখপাত্র দাবি করেছিলেন, তাদের কাছে তথ্য আছে যে, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা সেখানে অবস্থান নিয়েছে।

 

শূন্যরেখায় পানি ও বাথরুমের সংকট

শূন্যরেখার বাসিন্দারা জানান, এখানে যথেষ্ট খাদ্য সাহায্য মিললেও তারা বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত পায়খানার সংকটে ভুগছেন। উদাহরণ হিসেবে তারা জানান, এখানে তারা যে ব্লকে থাকছেন, সেখানে এক হাজার পরিবারের জন্য মাত্র একটি নলকূপ রয়েছে, আর পায়খানা মাত্র তিনটি।

তবে এসব পায়খানার একটিও মহিলাদের ব্যবহার উপযোগী নয় উল্লেখ করে তারা জানান, এ কারণে অধিকাংশ মহিলা দিনের বেলা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারেন না।

তবে এসব সমস্যা ছাপিয়ে তাদের মূল আক্ষেপ দেশে ফিরতে না পারা নিয়ে।

“আমাদের আসল সমস্যা দেশে ফিরতে না পারা। আমরা জন্মভূমিতে ফেরার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘ইনসাফ’ চাই, ‘জাস্টিস’ চাই,” বলেন দিল মোহাম্মদ।

হাফেজ ওমর সুলতানও বলেন, “এখানে ভালো লাগে না। নিজের দেশে আমরা মানসম্মান নিয়ে ছিলাম। কাজ-কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্যে শান্তি ছিল। কিন্তু এখন সুবিধাজনক অবস্থায় নেই।”

জেলে খেটেও ফিরছে শূন্যরেখায়

ফারুক জানান, কাঁটাতারের বেড়ার আশপাশে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে ১১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিপি। যার মধ্যে ৮৫ বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন। সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতরের আগে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।

জেল খেটে আবার শূন্যরেখায় ফেরতও এসেছেন অনেকে। এদের একজন আবু তাহের (৫০)। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি কাঁটাতারের পাশে শুকনো জ্বালানি কাঠ কুড়াতে গিয়ে বিজিপির হাতে আটক হয়েছিলেন তিনি।

তাহের বেনারকে জানান, চার মাস মিয়ানমারের জেলে ছিলেন তিনি। মুক্তি পেয়ে এক দালালকে সাত হাজার টাকা দিয়ে শূন্যরেখায় ফিরে এসেছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।