বিরোধিতার পরেও মেশিনে ঢাকা সিটি নির্বাচন
2020.01.31
ঢাকা
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর মাধ্যমে ভোটের ফলাফল জালিয়াতির আশঙ্কা এবং ভোট নিয়ে সরকার ও কূটনীতিকদের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যেই শনিবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সাড়ে ৫৪ লাখের বেশি ভোটার ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র এবং ১৭২ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত করবেন।
এবারই প্রথম ঢাকা সিটি নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া ইভিএম’র মাধ্যমে সম্পন্ন হবে এবং কোনো কাগজের ব্যালট পেপার থাকবে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের ইভিএম প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাইদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার ত্রিশ মিনিট পর অর্থাৎ বিকাল সাড়ে চারটার মধ্যে কেন্দ্রে ফলাফল প্রকাশ সম্ভব।
ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, "সকল ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বিকাল ছয়টার মধ্যে অবশ্য প্রকাশের জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।"
দলীয় ব্যানারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে উত্তর সিটি কর্পোরেশনর মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আতিকুল ইসলাম। দক্ষিণে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আওয়াল এবং দক্ষিণে প্রয়াত সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢাকা সিটি নির্বাচন জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে জানান বিশ্লেষকরা।
সরকার-কূটনীতিকরা মুখোমুখি
২৬ জানুয়ারি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেনের বাসায় গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন।
এছাড়া শুক্রবার তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথেও দেখা করেন।
এদিকে বুধবার ঢাকা সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নয় পশ্চিমা কূটনীতিক এক যৌথ বিবৃতি দেন।
কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়।
বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “কূটনীতিকরা কোড অব কনডাক্ট মেনে চলতে না পারলে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে পারেন।”
তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, ১০ বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত ২৮ বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসাবে নাম লিখিয়েছন। এটি আইনসিদ্ধ নয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেছেন, “বিদেশি দূতাবাসে কর্মরত বাংলাদেশিরা বিদেশি পর্যবেক্ষক হতে পারবেন না।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব অনুযায়ী ঢাকা সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করবে।”
বিএনপির ‘জালিয়াতির’ আশঙ্কা
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “আমরা সকল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে। কারণ সারাবিশ্বের সকল দেশ ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিচ্ছে। আর আমাদের দেশে এগুলো আমদানি করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এই ইভিএম এর ব্যাপারে আপত্তি দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “ইভিএম ব্যবহার করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এগুলো ব্যবহার করে ফলাফল জালিয়াতি করা যায়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেহেতু সরকার তাদের ব্যবহার করে ঢাকা সিটিতে জয়ী হতে চায়।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সরকার ভবিষ্যতে সকল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার প্রস্ততি নিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “ইভিএম ব্যবহারের কারণ হলো আওয়ামী লীগের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। আর সেকারণে তারা এই ইভিএম ব্যবহার করে জালিয়াতি করে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতে চায়।”
তবে তাঁর অভিযোগ নাকচ করে ইভিএম প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাইদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কেউ যদি এই ইভিএম’র সুনির্দিষ্ট দোষ বের করতে পারে তাহলে তাদের এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেয়া হবে।”
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবির কাওসার বেনারকে বলেন, “বর্তমানে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। ভোট হবে। জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই নির্বাচিত হবেন। এখানে সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই।”
তিনি বলেন, “যারা ইভিএম’র বিরোধিতা করছেন তাঁদের উচিত একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে কথা বলা। এভাবে ঢালাও কথা গ্রহণযোগ্য নয়।”
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী নির্বাচন কমিশনের ইভিএম প্রবর্তন বিষয়ক কারিগরী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ব্যালট পেপার ছাপার ব্যবস্থা ছাড়া ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে মতামত দেননি বলে বেনারকে জানান।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা বলেন, “বর্তমানে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো মূলত চীন থেকে আমদানি করা। সেটাকে কিছুটা ইমপ্রুভাইজড করেছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি। আমার মনে হয়, মেশিনগুলো যে একবারে নির্ভুল সেটি বলা কঠিন। সেকারণে এটি গ্রহণযোগ্য করার জন্য ব্যালট পেপার প্রিন্টের অপশন ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা উচিত নয়।”
তিনি বলেন, “আমি নির্বাচন কমিশনকে বলেছিলাম, এই ইভিএম’র সাথে ব্যালট প্রিন্ট করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেমন ভারতে প্রতিটি ইভিএম’র সাথে প্রিন্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে।”
“একজন ভোটার মেশিনে ভোট দেয়ার সাথে সাথে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপারের একটি ছাপা কপি চলে যাবে। সেগুলো কেউ দেখতে পারবে না,” বলেন তিনি।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা বলেন, “আমাদের নির্বাচন নিয়ে সবসময় প্রশ্ন ওঠে। ব্যালট পেপার ছাপানোর ব্যবস্থা ছাড়া যদি কোনো ফলাফল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তখন কী হবে? তবে রকিব উদ্দিনের নির্বাচন কমিশন আমার কথা না রেখে ইভিএম কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “ঢাকা সিটি নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক গতিধারার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুদলই চাইবে মেয়রের পদ দুটি নিজেদের দখলে রাখতে।”
তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ। সেই নির্বাচন দেশের জনমত আওয়ামী লীগের দিকে নিতে অনেক ভূমিকা রেখেছিল।
অধ্যাপক ড. নিজাম বলেন, “আর সেকারণে আওয়ামী লীগ যেভাবে হোক নির্বাচনে জিততে চাইবে। আবার বিএনপি প্রার্থী যদি মেয়রের পদে নির্বাচিত হতে পারেন, সেক্ষেত্রে সারাদেশে দল চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এবং তখন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন শুরু হতে পারে।”