রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, সমালোচনার ঝড়
2019.12.17
ঢাকা
আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯। ইস্টার্ন সময় দুপুর ০২.১৫
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর প্রকাশিত স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রথম তালিকায় সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম আসায় নিন্দার ঝড় উঠেছে বাংলাদেশে।
সমালোচনার মুখে দুঃখ প্রকাশ করে তালিকা সংশোধন করা হবে বলেও জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্বাধীনতার চার দশক পরে এ ধরনের তালিকা প্রকাশে গবেষকদের সহায়তা নেওয়া ও তা প্রকাশের পূর্বে সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন ছিল। ভুলে ভরা এই তালিকার কারণে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেলো বলে মনে করছেন তাঁরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বেনারকে বলেন, “স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা আমরা সব সময় চেয়েছি। তবে এমন লেজেগোবরে তালিকা চাইনি।”
“দায় স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে," উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কোনো রকম যাচাই-বাছাই, দালিলিক প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের তালিকা প্রকাশ করাটা বিভ্রান্তিকর। অবিলম্বে এই তালিকা প্রত্যাহার করা উচিত।”
ভুলে ভরা এই তালিকা সম্পূর্ণ আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে কাজ করার প্রতিফলন বলেও মন্তব্য করেন মুনতাসীর মামুন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরীর মতে, “আরও একটু দক্ষতার সাথে তালিকাটা তৈরি করা উচিত ছিল।”
“১৯৭৩ সালে রাজাকারদের বিচার হয়েছিল। এমনকি ফাঁসির আদেশও হয়েছিল দু’একজনের। সেই তালিকার রেফারেন্স নেওয়া দরকার ছিল। পাশাপাশি যারা এ তালিকার ওপর কাজ করেছেন, তাঁদের সহায়তা নিলেও ভালো হতো,” এই গবেষক বলেন।
আমাদের সদিচ্ছার চেয়ে দক্ষতার অভাব উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, “ওনারা (সংশ্লিষ্টরা) কি মন্ত্রণালয়ে বসে একটা তালিকা দেখে এটা বের করে ফেললেন? এটা তো গবেষকদের বিষয়।”
“গবেষকদের যুক্ত না করেই ১৯৭১ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা প্রবণতা বাংলাদেশে হয়েছে। এটা তারই ফল,” বলেন আফসান চৌধুরী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৪৮তম বিজয় দিবসের ঠিক আগের দিন গত ১৫ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর বেতনভোগী ১০ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধীর প্রথম তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে পুরো তালিকা প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়।
রোববার তালিকা প্রকাশের দিন সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস তাদের স্থানীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির সহায়তায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনের সন্ত্রমহানি করেছে।
তবে ওই তালিকায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ তালিকায় এমন অনেকের নাম রয়েছে যাদের কেউ কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, কেউ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যদের নামও রয়েছে এই তালিকায়। অথচ চিহ্নিত অনেক রাজাকারের নাম এই তালিকায় নেই।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ
এদিকে এই তালিকা প্রকাশ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীর দেওয়া ব্যাখ্যায় বলা হয়, “অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, এ তালিকায় বেশ কিছু নাম এসেছে, যারা রাজাকার, আল-বদর,আল-শামস, শান্তিকমিটি বা স্বাধীনতাবিরোধী নন, বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বা মুক্তিযোদ্ধা। এ ধরনের কোনো ব্যক্তির নাম তালিকায় কীভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
মন্ত্রীর পক্ষ থেকে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশপূর্বক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রকাশিত তালিকায় ভুলভাবে যদি কারও নাম এসে থাকে, আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই করে তাদের নাম এ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে।”
দুই মন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
এদিকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মঙ্গলবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, “প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে যেভাবে তালিকাটা পাওয়া গেছে, সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে।”
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো নোট ছাড়াই রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারদের যে তথ্য আছে, সেগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছিল।”
রাজাকারের তালিকা করা দুরূহ ব্যাপার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে দালাল আইনে যাদের নামে মামলা হয়েছিল, সেই দালাল আইনের লিস্টটা পাঠিয়েছি। সেই লিস্টে আমরা মন্তব্য করে দিয়েছি, অনেকের নামের মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। প্রকাশিত তালিকায় সেটা যথাযথভাবে আসেনি।”
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আরও নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই করে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অপমানজনক
দেশ স্বাধীনের জন্য সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার পরেও রাজাকারের তালিকায় নাম থাকাটা অপমানজনক বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এ বিষয়ে কথা বলার সময় মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও রাজাকারের তালিকায় নাম আসা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ ও অভিমান।
বেনারকে তিনি বলেন, “কী বলব বলুন তো! একসময় দেশের জন্য প্রাণ বাজি রেখেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। এখন প্রায় ৫০ বছর পরে শুনছি আমার নাম রাজাকারের তালিকায়। আমি বাকরুদ্ধ। এটা অপমানজনক।”
তবে কীভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম এলো, তা খুঁজে বের করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে নয় নম্বর সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন বরিশালের অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী। তাঁর বাবা সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল পাক বাহিনী। অথচ প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকায় তপন চক্রবর্তী ও তাঁর মা উষা রানী চক্রবর্তীর নাম এসেছে।
এর প্রতিবাদ জানিয়ে তপন চক্রবর্তীর মেয়ে বাসদ নেতা ডা. মনীষা চক্রবর্তী সোমবার ফেসবুক লাইভে বলেছেন, “এটা শুধু মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করা হয়েছে।”
বিষয়টি অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে তিনি তপন কুমার চক্রবর্তীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপত্র ও সম্মানী ভাতা নেওয়ার দলিল তুলে ধরেন।