বিতর্কিত রাজাকারের তালিকা স্থগিত করল সরকার
2019.12.18
ঢাকা
ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা স্থগিত করার ষোষণা দিয়েছে সরকার। বিজয় দিবসের আগের দিন গত ১৫ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ ওই তালিকা প্রকাশ করেছিলেন।
তালিকায় নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়।
স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম আরিফ-উর-রহমান বেনারকে বলেছেন, “প্রকাশিত তালিকায় সুস্পষ্টত অনেক ভুল আছে। ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে সঠিক তালিকা প্রকাশ করা হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই তালিকা প্রণয়নে আমার দপ্তরের কোনও হাত ছিল না। তবে তালিকাটি তাড়াহুড়া করে প্রকাশ করাটা আমাদের ভুল হয়েছে।”
পরবর্তীতে কবে নাগাদ শুদ্ধ তালিকা প্রকাশ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা আপাতত কোনও সময় নির্ধারণ করে দিচ্ছি না। এক ভুল বারবার করা যাবে না। নির্ভুলভাবে প্রকাশ করতে যতটা সময় লাগে নেওয়া হবে।”
এর আগে দুপুরে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই তালিকা যাচাই-বাছাই ও সংশোধনের পর নতুন করে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের কিছুক্ষণের মধ্যেই তালিকাটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নামিয়ে ফেলা হয়।
এরপর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বক্তৃতাকালে এ তালিকার কারণে ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানান। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় থাকা অসম্ভব। প্রকাশিত তালিকা রাজাকারের তালিকা নয়। অনভিজ্ঞতার কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এরকম তালগোল পাকিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি মুক্তিযোদ্ধামন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি এখন তাড়াহুড়ো করে এটা করতে যাইয়েন না। কারণ, এই তালিকার মধ্যে কী আছে না আছে দেখে নিতে হবে। আমি বলেছিলাম, তালিকায় অনেক ঝামেলা মিলিটারি ডিক্টেটররা করে রেখে গেছে।”
ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও টিপুর আবেদন
প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় লেখা হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম। তালিকাটি স্থগিত করার ঘোষণা আসার আগে বুধবার সকালে ঐ তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার চেয়ে মুক্তযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন টিপু।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে তথ্যের ভিত্তিতে গোলাম আরিফ টিপুর নাম রাজাকারের তালিকায় এসেছে, সে তথ্যের কপি চাওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।”
এর আগে মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে টিপু বলেন, “আমি একজন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯ ও ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। অথচ আমার নাম রাজাকারের তালিকায়! আমি সত্যিই হতবাক, মর্মাহত, বিস্মিত ও অপমানিত।”
গোলাম আরিফ টিপু বলেন, কীভাবে রাজাকার আলবদর তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম এলো, সেটি কীভাবে হলো– এর উৎস খুঁজে বের করতে হবে। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানান তিনি।
বরিশালের ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী ও তাঁর মা শহীদজায়া উষা রানী চক্রবর্তীর নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আসায় মঙ্গলবার বিক্ষোভ হয় সেখানে।
তালিকা রাজাকারদের নয়, দালাল আইনে মামলার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা রাজাকার, আলবদর, আলশামসের তালিকা নয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বুধবার সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এটি হচ্ছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সালের দালাল আইনে যাদের নামে মামলা হয়েছে তাঁদের নামের তালিকা। অনেকে শত্রুতাবসতও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। সেই নামগুলোও এই তালিকায় আছে। এর মধ্যে ৯৯৬ জনকে বিভিন্ন অভিযোগ থেকে খালাসও দেওয়া হয়। আমরা খালাসপ্রাপ্তদের নামের ওই তালিকাটিও নোট হিসেবে যুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়েছিলাম।”
এমন একটি ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমি অবশ্যই মানসিকভাবে আহত হয়েছি। এ ধরনের ভুল কতখানি সহনীয় তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করা হবে।”
জানা গেছে, রাজাকারদের তালিকা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ৬০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। এই টাকা কোথায় খরচ হয়েছে সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তালিকায় আওয়ামী লীগ বেশি: বিএনপি
বুধবার নয়া পল্টনে বিরোধীদল বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতাকর্মীরাই সংখ্যায় বেশি। অন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে এবার আওয়ামী লীগ নিজেরাই ফেঁসে গেছে।”
তিনি বলেন, “এতে জনগণ অবাক হয়নি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
তালিকাটি প্রত্যাহরের সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রিজভী বলেন, “আওয়ামী লীগের থলের বেড়াল বের হতে শুরু হওয়ায় তা প্রত্যাহারের প্রশ্ন উঠেছে।”
রাজাকারের তালিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেরাই ‘কুতর্কে লিপ্ত’ হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রিজভী।