বিডিআর বিদ্রোহ মামলার রায়, ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড
2017.11.27
ঢাকা
ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে ৫৭জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনায় ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন দিয়েছে হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ। দেশের ইতিহাসে হতাহতের ঘটনা এবং মৃত্যদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা বিবেচনায় এটি সবচেয়ে বড় মামলা।
রোববার থেকে শুরু করে সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ ওই রায় ঘোষণা করে। রায়ের ব্যাপ্তি ১০ হাজার পৃষ্ঠা।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলতে পিলখানায় নির্বিচারে সেনা কর্মকর্তাদের খুন করা হয়। পাশাপাশি আদালত এত বড় ঘটনার খবর কেন বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী জানতে পারল না তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে।
নানা কারণে পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের এই রায় গুরুত্বপূর্ণ ও নজিরবিহীন। স্বাধীন বাংলাদেশে একসঙ্গে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে খুন করার ঘটনা এই প্রথম।
তা ছাড়া এই মামলা আসামি সংখ্যার দিক থেকেও রেকর্ড। এতে আসামি ছিলেন ৮৪৬ জন।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতে ১৫২ জনের ফাঁসি ও ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছিলেন ২৭৮ জন।
চার বছরেরও বেশি সময় পর ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করল আদালত। তা ছাড়া ১৮৫জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পেয়েছেন ৪৯ জন। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের জরিমানা মওকুফ করেছে আদালত।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিডিআর বিদ্রোহের সময় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজন। তাঁরা রায়টি দ্রুত কার্যকর হয়েছে তা দেখার অপেক্ষায় আছেন বলে জানান।
কথা হচ্ছিল নিহত কর্নেল মো. মজিবুল হকের স্ত্রী নেহরীন ফেরদৌসীর সঙ্গে।
“অনেক দেরিতে হলেও আদালত রায় দিয়েছেন। আমরা তো সব হারিয়েছি। বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। রাষ্ট্র এখন ন্যায় বিচার নিশ্চিত করুক,” নেহরীন ফেরদৌসী বেনারকে বলেন।
এদিকে রোববার থেকেই নিম্ন আদালতে অভিযুক্ত বিডিআর সদস্যদের স্বজনেরা আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করেছিলেন। তাঁরা আশা করছিলেন সাজার মেয়াদ কমে আসবে। দিন শেষে কাউকে কাউকে আনন্দাশ্রু নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে, কেউ কাঁদছিলেন হাউমাউ করে।
আট বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আটক নায়েক সুবেদার আলী আকবর। নিম্ন আদালতে ফাঁসির রায় হয়েছিল। গতকাল আদালত তাঁকে খালাস দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী রেহানা আক্তার কথা বলেন বেনার নিউজের সঙ্গে।
“এমন একটা ঘটনা যে মুখ দেখাতে পারি নাই। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীকে। জেলে যাওয়ার পর থেকে কষ্টও করেছিলাম খুব। কিন্তু আমি জানতাম আমার স্বামী নির্দোষ,” এই বলে কাঁদতে থাকেন আলী আকবরের স্ত্রী রেহানা আক্তার।
আদালত সঠিক সাজা দিয়েছেন
হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন ও আপিলের রায় ঘোষণার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, আদালত সঠিক রায় দিয়েছেন।
“তৎকালীন বিডিআরকে শূন্য করা ছিল বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য। তাদের স্লোগান ছিল সেনাবাহিনী থেকে কেউ বিডিআরে আসতে পারবে না। আদালত সঠিক সাজা দিয়েছেন,” মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন। রায়ে খালাসপ্রাপ্তদের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ আবার আপিলে যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রায় দেওয়া শুরু করেন। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে রায়ের খুঁটিনাটি ও পর্যবেক্ষণ দেন তাঁরা।
পরদিন সোমবার আবারও বেলা ১১ টা থেকে রায় ঘোষণা শুরু হয়। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ ও রায় ঘোষণা করেন আদালত।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বলেছেন, যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদের সবাই ছিলেন ‘গোল্ডেন সান’। এমন সোনার ছেলে গড়তে বহু বছর লেগে যাবে। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচারের স্বার্থে শুনানিতে তাঁরা দীর্ঘ সময় নিয়েছেন।
বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা ছিল ওই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য। বিদ্রোহীরা শুধু সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেনি। তাদের লাশ গুম করেছে। পিলখানার ভেতরে থাকা নারী-শিশুদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। তারা যে নির্মমতার দৃষ্টান্ত রেখেছে সে কলঙ্ক তাদেরও বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে।
মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন ও আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্টেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার কিছু সুপারিশ করেন।
নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বিডিআরের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডালভাত কর্মসূচির মতো উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা উচিত নয়, যেকোনো পেশায় ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের মধ্যে পেশাদারী সম্পর্ক থাকা ও বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী মাঝে মাঝে মত বিনিময় করা প্রয়োজন।
“পিলখানায় বিদ্রোহের আগে অধস্তনদের কিছু দাবিদাওয়া বিডিআরের ঊর্ধ্বতনদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিকতা দূর করতে হবে। যদি কোনো প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ থেকে থাকে, তা প্রশমন করার উদ্যোগ নিতে হবে ও কারও পাওনা থাকলে দ্রুত পরিশোধ করতে হবে,” বলেন নজরুল ইসলাম তালুকদার।
বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী কেন বিদ্রোহের বিষয়টি আগে আঁচ করতে পারেনি তা তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টা ২৫ মিনিটে সূত্রপাত। বিডিআরের ডাল-ভাত কর্মসূচির লভ্যাংশ নিয়ে দরবারে ওঠা প্রশ্নকে ঘিরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে দরবার হলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিডিআর সদস্যরা ঢুকে পড়ে।
প্রথমে বিডিআর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালককে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি কর্মকর্তারা আত্মরক্ষায় কেউ ওয়াশ রুমে, কেউ মঞ্চের গ্রিন রুমে লুকিয়ে পড়েন। বিডিআর সদস্যরা খুঁজে খুঁজে হত্যাযজ্ঞ চালায়। অস্ত্রাগার লুট করে।
সোয়া ১২টার দিকে হেলিকপ্টার থেকে আত্মসমর্পণের জন্য লিফলেট ছড়ানো হয়। সেই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিডিআর সদস্যরা।
আলোচনার জন্য ওই দিন বেলা দেড়টার দিকে বিডিআর ৪ নম্বর ফটকে যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম। বিকেল ৪টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিদ্রোহীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন।
সন্ধ্যা ৬ টায় জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন ও ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেন। বিদ্রোহীরা বলেন, পিলখানার ভেতরে সেনা কর্মকর্তারা সুস্থ আছেন।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিদ্রোহীরা প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানায় এবং আবারও পিলখানার ভেতরে তাণ্ডব শুরু করে। রাতের দিকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে লাশগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলে বিদ্রোহীরা।
২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ভাষণ দেন। তিনি সবাইকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেন। সন্ধ্যা ৬টা থেকে অস্ত্র সমর্পণ শুরু হয়।
পরদিন পিলখানায় প্রবেশ করে সেনাবাহিনী। উদ্ধার হয় সেনা কর্মকর্তাদের গণকবর।