বিডিআর বিদ্রোহের এক যুগ: কেউ বেকসুর, কারো সাজার মেয়াদ শেষ তবু মুক্তি মিলছে না কারো

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.02.25
ঢাকা
বিডিআর বিদ্রোহের এক যুগ: কেউ বেকসুর, কারো সাজার মেয়াদ শেষ তবু মুক্তি মিলছে না কারো ঢাকার আদালতে হাজিরা দেবার পর বিদ্রোহে অভিযুক্ত দুজন সাবেক বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদস্যকে জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ১২ আগস্ট ২০১২।
[বেনারনিউজ]

এক যুগ আগে বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালে হত্যাকাণ্ড মামলা থেকে যারা বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন তাঁদের কেউই এখনো জেল থেকে ছাড়া পাননি। একইভাবে দণ্ডপ্রাপ্ত যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাঁরাও মুক্তি পাচ্ছেন না। সব মিলে এই সংখ্যা ৫৩৪ জন। 

বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির ওই বিদ্রোহে ৫৭ জন পদস্থ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। 

ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একক কোনো মামলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুদণ্ডের উদাহরণ।

বিচারিক আদালতে ২০১৩ সালের নভেম্বর এবং উচ্চ আদালতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে এই মামলার রায় হয়। 

তবে ওই বিদ্রোহের ঘটনায় পৃথকভাবে দায়ের করা বিস্ফোরক মামলার রায় না হওয়ায় হত্যা মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়া আসামিসহ অন্যরাও মুক্তি পাচ্ছেন না। 

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বেনারকে জানান, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সাড়ে আটশ' মানুষকে আসামি করে একটি হত্যা এবং আরেকটি বিস্ফোরক মামলা দায়ের করে সরকার। বিপুল সংখ্যক আসামির বিচার করতে ঢাকার বকশিবাজারে আদালত স্থাপন করা হয়।

তিনি জানান, আদালত স্থাপনের গেজেটে ওই আদালতে “একইসাথে হত্যা মামলা এবং বিস্ফোরক মামলার বিচার সম্পন্ন হবে,” বলে উল্লেখ করা হয়।

“দেখা গেলো হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় ২০১৩ সালের নভেম্বরে শেষ হলো। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিস্ফোরক মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই,” বলেন আমিনুল ইসলাম। 

তিনি জানান, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ আসামিদের আপিলের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায় ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। এতে ২৭৮ জনকে বেকসুর খালাস ও বর্তমানে কারাগারে থাকা আরো ২৫৬ জনের ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। ইতিমধ্যেই যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

“কিন্তু ওই ৫৩৪ জন এখনও কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলা চলমান,” বলেন আমিনুল ইসলাম।

“এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, যার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, এমন মানুষের “জেলে থাকা আইনসিদ্ধ নয়।” 

বিডিআরের সাবেক জওয়ান আব্দুর রশীদ (৬৫) ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সদর দপ্তরে যোগ দেন। ২০১১ সালে চাকরি থেকে তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। বিদ্রোহের কয়েকদিন পর আটক হন তিনি।

তাঁর বড়ো ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন শাকিল (২৭) বেনারকে জানান, ২০১৩ সালে বিচারিক আদালত রশীদকে বেকসুর খালাস দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারও কোনো আপিল করেনি। কিন্তু মুক্তি পাননি তিনি।

“আমার বাবার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু এখনও মুক্তি পাননি তিনি। বলা হচ্ছে, বিস্ফোরক মামলার বিচার হয়নি বিধায় বাবাকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না,” বলেন শাকিল। 

বর্তমানে ৬৫ বছর বয়স্ক আব্দুর রশীদের বহুমূত্র, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিসহ বিভিন্ন রোগ রয়েছে জানিয়ে শাকিল বলেন, “বাবার চিন্তায় আমার মা এখন মানসিক রোগী। আমি এখনও কোনো চাকরি পাইনি। আমার ছোট ভাই লেখাপড়া করছে। আমরা ভালো নেই।” 

মুক্তি দেয়া উচিত

যারা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হননি এবং যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাঁদেরকে “মুক্তি দেয়া উচিত” বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।

“বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিস্ফোরক মামলাটি হত্যা মামলার সাথেই শেষ করা উচিত ছিল,” মন্তব্য করে ব্যারিস্টার শফিক বেনারকে বলেন, “সরকারের উচিত বিস্ফোরক মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা।”

তাঁর মতে, “ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুক্তির জন্য আবেদন করতে পারেন। আবার বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে তাঁদের মুক্তি মিলতে পারে।”

অ্যাটর্নি জেনারেল এ. এম. আমিন উদ্দিন বেনারকে বলেন, “বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলাটি একটি ট্রাইবুনালে শেষ হয়। আর বিস্ফোরক মামলাটি নিয়মিত আদালতে চলছে। সুতরাং, দুই মামলা একসাথে চলতে হবে, তার মানে নেই।” 

বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় ২০০৯ সালে সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জওয়ানরা। ওই বিদ্রোহে সস্ত্রীক বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ এবং ৫৬ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। 

রাজধানীর লালবাগ থানায় ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে পুলিশ।

২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে একটি সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরো ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০ জনে। 

বিস্ফোরক আইনে ৭৮৭ জনকে অভিযুক্ত করে আলাদা একটি অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর সম্পূরক চার্জশিটে আরো ২৬ জনকে আসামি করা হয়। বর্তমানে এ মামলার আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন।

বকশিবাজারে মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে এক সাথে মামলা দুটির বিচারকাজ শুরু হয় ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে হত্যা মামলাটির রায় দেয় এই আদালত।

এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে আসামিপক্ষ। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর আপিলের রায় দেয় বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। 

রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এছাড়া যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা এবং ৪৫ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

নিম্ন ও উচ্চ আদালতে হত্যা মামলার সাড়ে ৮শ’ আসামির মধ্যে খালাস পান ২৭৮ জন এবং বিচার চলাকালে মারা যান চার জন। অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি এখনও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।