ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে

শরীফ খিয়াম
2019.08.13
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো প্রকাশ পাচ্ছে নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত মানববন্ধন। এপ্রিল ১২, ২০১৯, ঢাকা বাংলাদেশ।
ছবি: এএফপি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত মসজিদ ও মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের অ​ভিযোগে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার কর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন, একজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষের যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুর আগে ওই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত যে সাহসী বক্তব্য দিয়ে গেছে -তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ঘটনার পর মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কেউ কেউ যৌন নিপীড়ন করার পর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে রেহাই পাচ্ছে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “নুসরাতের মৃত্যুর পর সমাজে যেন একটি ধাক্কা লেগেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের ঘটনা সাধারণত প্রকাশ হয় না। তারপরও এক মাসের এই সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক। তবে এমন অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত থাকে।”

গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ঝাড়ফুঁকের নামে, জ্বীনের ভয় দেখিয়ে; এমনকি পবিত্র কোরআন শরীফ হাতে দিয়ে শপথ করিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রীদের ধর্ষণ বা ছাত্রদের বলাৎ​কার করার অভিযোগ রয়েছে ধর্মীয় এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

“সমাজের যে শ্রেণির কাছে আমরা সবচেয়ে বেশি মূল্যবোধ প্রত্যাশা করি, অর্থাৎ যারা ধর্মকর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষাদানের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত, তাদের ভেতর যদি বিচ্যুতি দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে সার্বিকভাবেই সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে,” বেনারকে বলেন কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হারুন-উর-রাশিদ আসকারী।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের এই সদস্য মনে করেন, “আমাদের সমাজে ধর্মীয় অপশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার; এসব রয়ে গেছে। প্রকাশ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতা দিয়ে আমরা হয়তো কিছুটা ঢেকে রাখি। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এগুলো বেরিয়ে আসে।”

ঢাকার তেজগাঁও রেলস্টেশন মাদ্রাসা ও জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের শাইখুল হাদীস (হাদিস বিশেষজ্ঞ) ও খতিব (খুতবা প্রদানকারি) মাওলানা মুশতাক আহমদ বেনারকে বলেন, “বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির জন্য বিপুলসংখ্যক আলেম–ওলামা লজ্জিত হচ্ছেন।”

তবে এমন পরিস্থিতিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল এই বিষয়ে আপাতত কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন বেনারের কাছে।

চোখ খুলে দিয়েছে নুসরাত

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করে অগ্নিদগ্ধ হওয়া মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানের ‘সাহসী জবানবন্দী’ তাঁর মতো নিপীড়িতাদের মুখ খুলে দিয়েছে।

গত ২৭ মার্চ যৌন নির্যাতন ও ৬ অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার নুসরাত গত ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যায়।

এর আগে হাসপাতালে যাওয়ার পথে এ্যাম্বুলেন্সে ভাইয়ের মোবাইলে রেকর্ড করা জবানবন্দীতে নুসরাত বলেন, “শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিয়েছে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো।” এই ‘অডিও ক্লিপ’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই দেশব্যাপী নিপীড়ন বিরোধী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

নূর খান লিটন বলেন, “নুসরাত মৃত্যুর আগে যে কথাগুলো বলে গেছে তাতে সাধারণ মানুষেরও চোখ খুলে গিয়েছে। তারা এখন জানে যে এমন অপরাধীরা মাদ্রাসা, মসজিদেও অবস্থান করে। ফলে বিষয়টা এখন গণনজরদারিতে চলে আসছে।”

নুসরাতের মৃত্যুর দিনই চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ গ্রামের পুটির বাজার এলাকার একটি মসজিদে ঢুকে ইমাম ছৈয়দ আহমেদের চোখেমুখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে মারধর করে বোরখা পরা তিন তরুনী।

ওই ইমামের বিরুদ্ধে উত্যক্তের অভিযোগ করেও প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগ তোলে হামলাকারীরা।

এক মাসে গ্রেপ্তার ১৯

নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত মসজিদ ও মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নের অ​ভিযোগে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত ৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্চের চাষাঢ়ার বাইতুল হাফেজ জামে মসজিদের তৃতীয় তলায় ঝাড়ফুঁকের নামে আট বছর বয়সী মাদ্রাসা ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ইমাম ফজলুর রহমান ওরফে রফিকুল ইসলাম (৪৫) এবং মসজিদ কমিটির পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

এর আগে ২৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন ভূইঘর দারুল হুদা মহিলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও বড় হুজুর মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয় ১১ ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে।

২৩ জুলাই রাতে চুয়াডাঙ্গা জেলার  আলমডাঙ্গার মাদ্রাসা ছাত্র আবির হুসাইন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কয়রাডাঙ্গা নূরানী মাদ্রাসায় চলমান বলাৎকারের ঘটনাগুলো আলোচনায় আসে। মাদ্রাসার দুই শিক্ষক ও পাঁচ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২২ জুলাই রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার একটি মসজিদের ইমাম ইদ্রিস আহম্মেদকে (৪২) একাধিক ধর্ষণ ও বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।  দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে মসজিদে নামাজ পড়ানোর পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করা এই ব্যক্তি জ্বীনের ভয় দেখিয়ে মসজিদের একটি কক্ষে এমন অপকর্ম চালিয়ে আসছিল ।

১২ জুলাই কক্সবাজারের উখিয়ায় ডেইলপাড়া মসজিদে সাত বছরের শিশুকে মসজিদের ভেতর নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয় মুয়াজ্জিন হাফেজ নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে। “পালিয়ে যাওয়ায় তাকে আটক করা সম্ভব হয়নি,” সাংবাদিকদের বলেন উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার।

১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা মইনপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে একই মাদ্রাসার শিক্ষক মো. রফিক মিয়াকে (২৪) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

৬ জুলাই ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় গলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের উত্তর চরবিশ্বাস হাদিউল উম্মা আবাসিক মহিলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক মোহম্মদ ফরাজী (৪০)। গত ২৬ জুন মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১১) নিজ কক্ষে ডেকে মুখ চেপে ধরে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

৫ জুলাই নেত্রকোনার কেন্দুয়ার আঠারবাড়ি এলাকায় একটি কওমি মহিলা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আবুল খায়ের বেলালীকে (৩৩) দশ বছরের এক ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে গনধোলাই দিয়ে ‍পুলিশে সোপর্দ করা হয়।  পরে পুলিশ জানায়, গত এক বছরে এই মাদ্রাসা অধ্যক্ষ আরও ছয় শিশুকে ধর্ষণ করেছে যাদের বয়স আট থেকে ১১ বছর।

৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মাহমুদপুর এলাকার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসা থেকে অধ্যক্ষ আল আমিনকে (৪৫) গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ১০–১২ জন ছাত্রীকে ধর্ষণের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় র‌্যাব।

দরকারদৃষ্টান্তমূলকশাস্তি

মানবাধিকার কর্মী, ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমদের মতে, এই প্রবণতা ঠেকাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিকল্প নেই।

নূর খান বলেন, “যখন ‘দৃষ্টান্তমূলক’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তখন এ জাতীয় ঘটনা কমে আসবে। তবে এটা বন্ধ হবে—এমনটা ভাবার কারণ নেই।”

মসজিদ ও মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

ড. আসকারি বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, সেটাই কিন্তু পরবর্তী ঘটনাকে পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং এই ধরণের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।”

ড. মুশতাকও বলেন, “একজনকে কঠিন শাস্তি দিয়ে হাজারজনকে শিক্ষা দিতে হবে। অপরাধ তো অপরাধই, তা যেখানে বা যে স্থানেই ঘটুক না কেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।