স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন করেছিল পুলিশ, বললেন শহিদুল আলম

আশীফ এন্তাজ রবি ও ইমরান ভিটাচি
2019.04.12
ওয়াশিংটন ডিসি
190412-BD-Alam-1000.JPG ওয়াশিংটন ডিসিতে বেনারনিউজের সাথে সাক্ষাৎকারে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ১০ এপ্রিল ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের’ দায়ে বাড়ি থেকে তুলে নেবার পর, ভবিষ্যতে সরকার নিয়ে আর ‘কোনো কিছু’ না বলতে রাজি করানোর জন্য পুলিশ তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন খ্যাতনামা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।

বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে বেনারনিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর গ্রেপ্তার পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই কথা বলেন তিনি।

গত বছর ঢাকায় শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনকে সমর্থন করে অনলাইনে সরকারের সমালোচনা করেন শহিদুল আলম। এর প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট রাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

পরদিন ‘সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার’ করার দায়ে পুলিশ তাঁকে তথ্য প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে।

রাত সাড়ে দশটায় বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ও পরের দিন বিকেলে আদালতে হাজির করার মাঝখানের সময়টাতে কী ঘটেছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে শহিদুল বলেন, “তারা বিশেষভাবে চেষ্টা করেছে, আমি যাতে কিছু ব্যাপারে স্বীকার যাই।”

“শুধু সরকার নিয়ে কোনোকিছু বলবে না,” তাঁর কাছ থেকে এই স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ তাঁকে মারধরের পাশাপাশি শরীরে পিন ফোটানো ও পানিতে চোবানোরও ভয় দেখিয়েছিল বলে জানান তিনি।

তবে শহিদুল আলমের এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ‘ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেছে পুলিশ সদরদপ্তর।

শহিদুল জানান, ৫ আগস্ট রাতে তিনি বাসায় একাই ছিলেন। রাত সাড়ে দশটার দিকে বেল বাজিয়ে এক তরুণী তাঁকে ‘আংকেল শহিদুল’ ডেকে দরজা খুলতে বলে।

দরজা খোলার সাথে সাথে আড়াল থেকে বেশ কয়েকজন লোক এসে তাঁকে জাপটে ধরলে, তাঁর ভাষায়, “কী ঘটতে যাচ্ছে ওই মুহূর্তেই তখন আমার কাছে খুব পরিস্কার হয়ে যায়।”

ফাঁকা বাসা থেকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে গুম করে ফেলা হতে পারে, এই আশঙ্কায় শহিদুল “আমাকে যে নেওয়া হচ্ছে সেটা যাতে অন্যরা জানতে পারে,” এই উদ্দেশ্যে যতদূর সম্ভব প্রতিরোধ তৈরি করে ঘটনাটাকে বিলম্বিত ও চিৎকার করে আশপাশ জানান দেবার চেষ্টা করেন।

পাঁচ তলা থেকে তাঁকে প্রথমে লিফটে ও পরে নিচে এনে গাড়িতে তোলার সময় তিনি পা দিয়ে লিফট আর গাড়ির দরজা আটকানোর চেষ্টা করেছেন বলে জানান শহিদুল। কেউ একজন তাঁর মুখ চেপে ধরলে তিনি সেই হাতে কামড় দিয়েও চিৎকার করেন বলে জানান তিনি।

তথ্য প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার দেখানোর পর শহিদুল আলমকে আদালতে হাজির করা হয়। ৬ আগস্ট ২০১৮।
তথ্য প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার দেখানোর পর শহিদুল আলমকে আদালতে হাজির করা হয়। ৬ আগস্ট ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

স্বীকারোক্তির জন্য নির্যাতন

গাড়িতে তুলে “হাত বাঁধা পেছনে, চোখে পট্টি দেওয়া,” অবস্থায় তাঁকে একটা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে পুলিশ শারিরীক নির্যাতনের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে বলে জানান শহিদুল।

তিনি বলেন ওই সময় “খুব আক্রমণাত্মকভাবে” প্রশ্ন করে “আমার কাছ থেকে একটা স্বীকারোক্তি বের করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।”

তাঁর গায়ে পিন ফোটানোর জন্য নির্যাতনকারীদের একজন আরেকজনকে “ওই পিনগুলো নিয়ে আসো,” বলে হুকুমও করেছে বলে জানান তিনি।

ভয় দেখিয়ে ‘আর কখনো সরকারের সমালোচনা করবেন না’ এই মর্মে স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পেরে পুলিশ তার ওপর শারিরীক নির্যাতন শুরু করে জানিয়ে শহিদুল বলেন, “তারপর আমার মাথার ওপরে ওজন রাখা হলো।”

এরপর তাঁর নাকেমুখে আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, “আমার তো চোখ বাঁধা। কাজেই কী দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটা আমি বলতে পারি না। ...কিন্তু আঘাত করার পর আমার মুখ থেকে, নাক থেকে রক্ত ঝরছে, আমি টের পাচ্ছি। রক্ত ঝরে আমার কাপড় ভিজে যাচ্ছে।”

এরপর পানিতে চোবানোর ভয় দেখানো হয়। শহিদুল বলেন, “একটা পর্যায়ে গিয়ে ওই পানির ট্রিটমেন্ট...। আমি তো বুঝি পানির ট্রিটমেন্টটা কী। ...বলছে তাকে ওয়াটারবোর্ডিং করতে হবে।”

পানিতে চোবানোর জন্য তাঁকে হাঁটিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর “আমার চোখের পট্টি খোলা হলো, তখন দেখি একটা জলাশয়ের সামনে আমি দাঁড়িয়ে,” বলেন শহিদুল

তিনি বলেন, “সেই মাঝরাতে অন্ধকারের মধ্যে আমার হাত বাঁধা। জলাশয়ের সামনে আমি দাঁড়িয়ে...।”

আটকের রাতে নির্যাতন করা হলেও পরের দিন ৬ আগস্ট সকালে পুলিশ সদরদপ্তরে ‘খুব ভালো আচরণ’ ও আপ্যায়ন করে ‘সরকার নিয়ে কোনোকিছু না বলার’ শর্তে তাঁকে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব করা হয় বলে জানান শহিদুল।

তিনি জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয়, “যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে, ওটা নিয়ে আমরা আর চিন্তা করব না। এটা পুরোপুরি মুছে যাবে, রেকর্ডেড কোথাও থাকবে না, তোমাকে আমরা বাড়ি পৌঁছে দেবো, তুমি শুধু এর পরে অন্যান্য বিষয় নিয়ে যা খুশি বলো, তাতে অসুবিধা নাই, শুধু সরকার নিয়ে কোনোকিছু বলবে না।”

চুপ থাকার শর্তে মুক্তির প্রস্তাবটি “আমার জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না” বলে প্রত্যাখ্যান করেন শহিদুল আলম। তিনি বলেন, “আমি আমার স্বাধীনতাকে বিক্রি করে, চুপ থেকে, যেটাকে তারা মনে করছে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা আমি চাই না, সেই স্বাধীনতা আমার কাছে স্বাধীনতা না।”

কোনো নির্যাতন হয়নি: পুলিশ

আটকের পর তাঁর ওপর নির্যাতনের কথা গত বছর ৬ আগস্ট গণমাধ্যম এবং আদালতেও বলেছিলেন শহিদুল আলম। তবে তাঁর এই অভিযোগ আগাগোড়াই অস্বীকার করে এসেছে পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মাসুদুর রহমান শুক্রবার বেনারকে বলেন “গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পুলিশের কাছে থাকাকালীন কখনো তাঁর ওপর কোনো নির্যাতন করা হয়নি।”

শহিদুল আলমকে পানিতে চোবানোর ভয় দেখানো হয়েছিল এমন অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।

সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না বলার শর্তে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে ছেড়ে দেবার প্রস্তাবটিও সত্য নয় বলে মন্তব্য করেন মাসুদুর রহমান।

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তারের পর আমরা কাউকে ছাড়তে পারি না। আমরা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করি, তারপর কাউকে ছাড়া না ছাড়ার একমাত্র এখতিয়ার আদালতের।”

“সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে কথা না বললে আমরা তাঁকে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব দিয়েছি বলে তিনি যে দাবি করেছেন, তা সত্য নয়,” যোগ করেন তিনি।

দীর্ঘ আইনি লড়াই করে ১০৭ দিন কারাবসের পর গত বছরের ২০ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান শহিদুল আলম।

কারাগারে থাকাকলে অন্য বন্দীরা তাঁকে ‘ভীষণভাবে সম্মান’ করেছে জানিয়ে শহিদুল বেনারকে বলেন, “আমি ভালো আছি কি না তাঁরা সব সময় খেয়াল রেখেছে।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।