সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি রাজনৈতিক ফাঁকা বুলি

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.07.31
ঢাকা
200731_BD_Shahidul_1000.jpg সরকারের সমালোচনার দায়ে ১০০ দিনের বেশি জেল খেটে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে গাড়িতে ওঠার আগে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে দেখাচ্ছেন শহিদুল আলম। ২০ নভেম্বর ২০১৮।
[এএফপি]

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনকে বৈধ করতে সরকার করোনাভাইরাস মহামারিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোচকিত্রী শহিদুল আলম।

দু বছর আগে ঢাকায় বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক ও গণমাধ্যমে সেই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোরতার সমালোচনা করার দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে ১০৭ দিন জেল খাটেন শহিদুল।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দুই বছর পূর্তির প্রাক্কালে শহিদুল আলম সম্প্রতি বেনারকে ইংরেজিতে এই ইমেইল সাক্ষাৎকার দেন।

তাঁর মতে, “বাংলাদেশে বরাবরই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে ছিল।”

তবে নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অসংখ্য গণমাধ্যম ও অধিকার কর্মীর গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং সরকার সমর্থক সাংবাদিকদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে বর্তমান বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা “একটি রাজনৈতিক ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে।”

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংবাদ চাপা পড়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে শহিদুল আলম বলেন, “সরকারও নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেবার জন্য ভাইরাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে জনগণের মৌলিক অধিকারের মধ্যে সর্বপ্রথম যেটি হারিয়ে গেছে তা হলো গণমামাধ্যমের স্বাধীনতা।”

তবে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী যে সকল গণমাধ্যম কাজ করতে রাজি হতো না সেগুলো আগে থেকেই সংকটে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, তার ওপর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

“কোভিড-১৯ সংক্রান্ত দুর্নীতির ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য অনেক সাংবাদিককে জেলে পাঠানো হয়েছে। এর ফলেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে” বলেন শহিদুল আলম।

তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে জনগণের মন জুগিয়ে চলায় সরকারের সামান্যতম যে দায় ছিল, নির্বাচনের পরে সেই দায়টাও বোধ করছে না সরকার।

তাঁর মতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকার সমর্থকদের দুর্নীতি বিষয়ে প্রতিবেদন করতে যাওয়া বিভিন্ন সাংবাদিক এবং দুর্নীতির তথ্যদাতাদের আটকের ঘটনা থেকে এটাই মনে হয় যে “নির্বাচনের পর রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে। এখন আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই।”

“সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৈধ কিছু প্রশ্ন উত্থাপনকারী কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আগের চেয়েও আরও কঠিন অবস্থায় রয়েছে,” বলেন শহিদুল আলম।

করোনাভাইরাসের কারণে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের আয় কমার পাশাপাশি বীমা পলিসির মূল্যও বেড়েছে, ফলে এসব দিক থেকেও সংবাদপত্রের সংকট বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

“যেসব সাংবাদিক স্বল্প বেতনে কাজ করেন তাঁরা টিকে থাকার জন্য অন্য কাজ করছেন,” বলেন তিনি।

তাঁর মতে, করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। কারণ বর্তমানে ‘প্রতিবেদন তৈরির খরচ’ বাড়ার পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে ঝুঁকিও বেড়েছে গণমাধ্যম কর্মীদের।

তবে দেশে করোনাভাইরাসে বেশিসংখ্যক সংবদাকর্মীর আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযুক্ত নীতিমালা না থাকাকে দায়ী করেন শহিদুল আলম।

তিনি বলেন, “কেউ পিপিই সরবরাহ করে, কেউ করে না। কেউ বীমা সুবিধা দেয়, কেউ দেয় না। কেউ চিকিৎসার খরচ দেয়, কেউ দেয় না।”

“আমার জানা মতে একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও সাংবাদিকদের কোভিড পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কোনো প্রশিক্ষণ দেয়নি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের সংক্রমণ এড়িয়ে নিরাপদে দায়িত্ব পালনের জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনির্দিষ্ট কোভিড-১৯ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

সাংবাদিকদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আমাদের গণমাধ্যম আমাদের অধিকার’র তথ্যমতে জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ৬৬৪ জন গণমাধ্যম কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন অন্তত ১৭ জন। এছাড়া করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন আরোও অন্তত ১০ জন গণমাধ্যম কর্মী।

এদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে শহিদুল আলমের অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সরকারের শীর্ষস্থানীয়রা।

“আমি শহিদুল আলমের বক্তব্য বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না,” বেনারকে বলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

অন্যদিকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বেনারকে বলেন, “শহিদুল আলম কী বলছেন সে বিষয়ে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাঁর যা ইচ্ছা তিনি বলতে পারেন।”

তবে এর আগে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ নাকচ করে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

গত ১ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে কথাটা ঠিক না। এই আইনের আওতায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা আরেকজনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবমাননাকর মন্তব্য লিখেছে। আর যারা সংক্ষুদ্ধ তারা মামলা করেছে।”

“এটি স্বাভাবিক যে মামলা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করবে,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে গত ৩০ জুন এক বিবৃতিতে দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ বলেছে, “করোনাকালে এখন পর্যন্ত ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

এছাড়া, জাতিসংঘের একটি ফাঁস হওয়া নথির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে গত মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশে বেনারনিউজের ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়া হয়।

জাতিসংঘের ওই নথিতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সঠিক পন্থা গ্রহণ না করলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রায় বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

এর পর থেকেই বাংলাদেশের পাঠকরা আর বেনারনিউজের সাইটে ঢুকতে পারছেন না।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার শাহবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। ১ আগস্ট ২০১৮।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার শাহবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। ১ আগস্ট ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

‘নিত্যদিনের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে’

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার ফুটপাতে অপেক্ষমান দুই শিক্ষার্থীকে একটি বেপরোয়া বাস চাপা দিয়ে হত্যা করলে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।

৮ আগস্ট পুলিশি অভিযানে মাধ্যমে দশ দিন ধরে চলা এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।

রাজপথ থেকে এই আন্দোলনের সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেন শহিদুল আলম। এছাড়া এ বিষয়ে তিনি কাতার ভিত্তিক আল-জাজিরা টেলিভিশনেও এক সাক্ষাৎকার দেন।

শহিদুল আলম অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন পুলিশের সাথে একত্রিত হয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

সাক্ষাৎকার প্রচারের পর ৫ আগস্ট শহিদুল আলমকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় (পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়) তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়।

এরপর ১০৭ দিন কারাগারে কাটিয়ে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর মুক্তি পান তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি এখনও চলমান।

‘ভয়ভীতি ও পক্ষপাতহীনভাবে’ সাংবাদিকতার জন্য জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এ বছরের ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত করেছে শহিদুল আলমকে।

তবে গ্রেপ্তার ও আটকের কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন শহিদুল আলম। নিরাপত্তাজনিত কারণে এখন আর তিনি একা কোথাও যেতে পারেন না বলে জানান।

এছাড়া সম্ভাব্য হয়রানি এড়াতে এখন অনেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ হতে ভয় পান বলে বাংলাদেশি সব খদ্দের তাঁর প্রতিষ্ঠান দৃক গ্যালারির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন বলে জানান শহিদুল আলম।

“সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় তাদের অনেকেই আমার কাছে আসতে ভয় পায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “একবার একটি মানবাধিকার সংস্থা আমাকে তাদের কর্মশালায় যেতে নিষেধ করেছে। কারণ আমি গেলে তাদের ক্ষতি হতে পারে।”

আগে তিনি নিয়মিত টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেলেও জেল থেকে বের হবার পর গত দুই বছর আর কেউ তাঁকে ডাকেনি বলে জানান শহিদুল আলম।

“কারণ আমাকে ডাকলে তারা সরকারের রোষানলে পড়তে পারে। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া সবাই আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকছেন,” বলেন তিনি।

শহিদুল বলেন, “আমি আগে যেভাবে সাইকেল চালিয়ে ঘুরতাম, এখন সেভাবে আর ঘুরতে পারি না। আমি কখনও একা চলাফেরা করি না।”

তাঁর অবস্থান যাতে শনাক্ত করা না যায় সেজন্য তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন বলেও জানান।

“এসব করতে গিয়ে আমার নিত্যদিনের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি যে ধরনের সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করতাম সেগুলো আর করতে পারছি না।”

তবে পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, “যখন কথা বলা দরকার আমি কথা বলি,” বলেন শহিদুল আলম।

তাঁর বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিরুদ্ধে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন জানিয়ে শহিদুল আলম বলেন, “একজনের লড়াই অন্যদের জন্য জায়গা তৈরি করবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।