আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের জামিন: বিব্রত হাই কোর্ট

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.09.04
ঢাকা
180904_Court_embarrassed_1000.JPG ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই’ শিরোনামে ঢাকায় দৃক আয়োজিত শহিদুল আলমের ছবির প্রদর্শনীতে দর্শকরা। ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
সৌজন্যে: দৃক

অনলাইনে সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে আটক ও ‘পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার’ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মুক্তি আরও বিলম্বিত হলো।

নিম্ন আদালতে গত ৫ আগস্ট তাঁর জামিন খারিজ হওয়ার পর আইনজীবীরা হাইকোর্টে আবেদন করেন।

তবে মঙ্গলবার হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ তাঁর জামিন আবেদন শুনতে বিব্রত বোধ করেন বলে বেনারকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ফলে, উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

শহিদুল আলমের আইনজীবি ব্যারিস্টার সারা হোসেন বিব্রত হওয়ার ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে অভিহিত করে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা শহিদুল আলমের জামিনের ‘শেষ চেষ্টা’ হিসাবে আবেদনটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হবেন।

গ্রেপ্তারের পরদিন ৬ আগস্ট আদালতে উপস্থিত করা হলে শহিদুল আলম অভিযোগ করেন, পুলিশি হেফাজতে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে।

আদালত সূত্রমতে, শহিদুল আলমের জামিন শুনানি করতে ২৯ আগস্ট সিদ্ধান্ত দেয় বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

মঙ্গলবার ওই দুই বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। এরপর বিচারপতিরা জানান, তাঁরা জামিন শুনানি করতে বিব্রত বোধ করছেন।

আদালতে শহিদুল আলমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সারা হোসেন, শাহদিন মালিক ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “আজ আদালত শহিদুল আলমের জামিন শুনানি করতে বিব্রত বোধ করেছেন।”

তিনি বলেন, “আদালত কেন বিব্রত বোধ করলেন তা সবসময় যে আইনজীবীদের ব্যাখ্যা করতে হবে ‘আমি এই কারণে বিব্রত করলাম’, এটা অ্যাজ এ ম্যাটার অব প্র্যাকটিস (আমাদের প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী), আমাদের কোর্টে কখনো হয় না।”

মাহবুবে আলম বলেন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের কোর্টে বিব্রত হওয়ার পর এখন জামিন আবেদনের “নথিপত্র প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। প্রধান বিচারপতি আবার অন্য কোনো বেঞ্চে এটাকে পাঠাবেন।”

মাহবুবে আলম বলেন, শহিদুল নিরপরাধ নন। তাঁকে সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আটক রাখা হয়েছে।

আদালতের সিদ্ধান্তের পর কোর্ট থেকে বেরিয়ে আটক শহিদুল আলমের অবস্থা সম্পর্কে সারা হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “তাঁকে আটকে রাখা হবে। তারপর তাঁকে জামিনের সুযোগ চাইতেই দেওয়া হবে না, তাঁর যে বক্তব্য তা শুনানির সুযোগ দেওয়া হবে না—এটাই কি আমাদের বাস্তবতা?”

তিনি বলেন, নিম্ন আদালত থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁরা ২৯ আগস্ট হাই কোর্টে শহিদুল আলমের জামিনের জন্য আবেদন করেন। আদালত পাঁচদিন আগে জামিন শুনানির সিদ্ধান্ত নেন।

হাই কোর্টের সিদ্ধান্তে মর্মাহত সারা হোসেন বলেন, “এই আদালতে এসেও যদি আমাদের ঘুরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কোথায় যাওয়ার আছে বলতে পারছি না। এখন আমরা শেষ আরেকটি চেষ্টা করব, সেটা হলো আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করব যে উনি যেন আমাদের আগামীকালের মধ্যে কোনো এক বেঞ্চে এই জামিন শুনানির সুযোগ করে দেন।”

কোনো সাধারণ মামলায় বিব্রত বোধ করার ঘটনা খুব বেশি দেখা যায় না বলে জানান আদালত সংশ্লিষ্টরা। সাধারণত রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল মামলায় বিচারকেরা বিব্রত বোধ করে থাকেন।

এর আগে বিএনপি শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানিতে বিচারকেরা অসংখ্যবার বিব্রত বোধ করেছেন।

সাবেক বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বেনারকে বলেন, “কোনো বিচারপতি যে কোনো কারণে যদি মনে করেন যে এই মামলায় তিনি কোনোভাবে প্রভাবিত হতে পারেন, অথবা ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ জড়িত, তখন বিচারকেরা সেই মামলা শুনতে বিব্রত বোধ করেন। এটা তাঁদের অধিকার। ন্যায় বিচারের স্বার্থেই এমন বিধান করা হয়েছে।”

২৯ জুলাই ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে শহিদুল আলম বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট দেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ‘উস্কানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে করা মামলায় ৬ আগস্ট শহিদুল আলমকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এর আগের দিন রাতে ধানমন্ডির বাসা থেকে তাঁকে তুলে নেয় ডিবি। রিমান্ড শেষে গত ১২ আগস্ট শহিদুলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় নিম্ন আদালত।

১৪ আগস্ট ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করা হলে ১১ সেপ্টেম্বর শুনানির জন্য দিন ধার্য হয়। এরপর ১৯ আগস্ট শুনানির তারিখ এগোনোর জন্য আবেদন করা হলে তা গ্রহণ করা হয়নি। এরপর ২৬ আগস্ট শহিদুল আলমের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চাইলে ওই আদালত শুনানির জন্য তা গ্রহণ করেনি। এ অবস্থায় ২৮ আগস্ট হাই কোর্টে তাঁর জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়, যা মঙ্গলবার আদালতের কার্যতালিকায় ছিল।

এদিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান শহিদুল আলমের মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। তাঁকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।

শহিদুল আলমের অপরাধের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা সঠিক। অপরপক্ষে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ সিদ্দিক শহিদুলের মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এক ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা জয় বলেন, শহিদুল আলমের “দেওয়া মিথ্যা পোস্ট ও অভিযোগের কারণেই শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয় এবং পুলিশের ওপর ও পার্টি অফিসে হামলা চালায়। একাধিক পুলিশ সদস্য ও আমাদের কর্মীরা আহত হন।”

জয় বলেন, “শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দ্রুত সহিংস হয়ে ওঠা এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপির ঢুকে পড়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের একজন ছিলেন শহিদুল। তাই জননিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।”

অপরপক্ষে টিউলিপ সিদ্দিক শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার হওয়াকে ‘অত্যন্ত পীড়াদায়ক’ হিসেবে অভিহিত করে অবিলম্বে এর অবসান হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দিটাইমস এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তিনি বলেন, “আমি আশা করি, বন্ধুরাষ্ট্র বিবেচনায় ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে দৃঢ় বার্তা পাঠাবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।