বারবার নাকচের পর শহিদুল আলমের পঞ্চম জামিন শুনানি রোববার
2018.10.05
ঢাকা
নিম্ন আদালতে খ্যাতনামা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে তিন দফা, উচ্চ আদালত বিব্রত হয়েছে একবার। পঞ্চমবারের মতো রোববার আদালত বসছে তাঁর জামিন আবেদন নিয়ে।
শহিদুলের পরিবার, সুহৃদ ও স্বজনেরা আশা করছেন, ওই দিন তিনি জামিন পাবেন। তাঁদের দাবি, দ্রুত শহিদুলের মামলার অভিযোগপত্র যেন পুলিশ দাখিল করে, এরপর আদালতে তাঁরা বিচারের জন্য লড়বেন।
যদিও পুলিশ বেনারকে জানিয়েছে, সহসা অভিযোগপত্র দাখিলের কোনো সম্ভাবনা নেই। কবে এটা দাখিল হতে পারে, সেই ধারণাও পুলিশ দিতে পারেনি।
“আমার বিশ্বাস তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো শেষ পর্যন্ত আদালতে টিকবে না। কারণ এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই,” বেনারকে জানান শহিদুলের স্ত্রী অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ।
শহিদুলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের একটি দল। দলটির প্রধান উপকমিশনার মশিউর রহমান।
“শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। অভিযোগপত্র কবে দেওয়া হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না,” মশিউর রহমান বেনার নিউজকে বলেন।
শহিদুল পালাতে পারেন!
আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, আদালতে পুলিশ যে নথি দাখিল করেছে সেখানে পুলিশের দাবি, জামিন পেলে শহিদুল আলম পালিয়ে যেতে পারেন। এতে আরও বলা হয়, আল জাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার ও ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট দিয়ে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে আরও বেশ কিছু অভিযোগ।
অবশ্য রেহনুমা আহমেদ বলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে যেসব যুক্তি পুলিশ তুলে ধরেছে সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক।
“শহিদুলের পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না,” বলেন রেহনুমা।
মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গত ৫ আগস্ট রাতে সাদা পোশাকে একদল পুলিশ ধানমন্ডির বাসা থেকে শহিদুল আলমকে তুলে নিয়ে যায়। ১২ ঘন্টারও বেশি সময় পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
গত দুই মাসে শহিদুলের পক্ষে তাঁর আইনজীবীরা জামিন আবেদন নিয়ে ছুটোছুটি করছেন নিম্ন ও উচ্চ আদালতে। কিন্তু জামিন আবেদন মঞ্জুর হয়নি। তবে বিশিষ্ট এই নাগরিককে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
আইনী লড়াইয়ের দুই মাস
৫ আগস্ট শহিদুলকে প্রথমে মহানগর হাকিমের আদালতে তুলে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। একই আদালতে জামিন আবেদন করেন শহিদুলের আইনজীবীরা। আদালত জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়।
১৪ আগস্ট আইনজীবীরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন, সেই আবেদনও নাকচ হয়ে যায়।
আইনজীবীরা ২৮ আগস্ট হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। ৪ সেপ্টেম্বর জামিন আবেদনের শুনানিতে বিব্রত বোধ করে আদালত। বিধি অনুসারে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চকে জামিন আবেদনের শুনানি করার নির্দেশ দেন। ওই বেঞ্চ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন মহানগর দায়রা জজ আদালতকে।
গত ১১ সেপ্টেম্বর দায়রা জজ আদালত জামিন আবেদন নাকচ করেন। সাতদিন পর আবারও আইনজীবীরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। রোববার বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ শুনানির রায় দেবেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে এ পর্যন্ত বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়েছে। যেমন, তিনি আল জাজিরাসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিভিন্ন মিথ্যা ও ক্ষতিকর তথ্য সম্প্রচার করেছেন। এ ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ জনমনে ভীতি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
এর বাইরেও যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার মধ্যে আছে শহিদুল সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের বন্ধু। বার্গম্যান যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়। তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্নসময় প্রশ্ন তোলেন।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের জামাতা বার্গম্যান এবং তাঁর স্ত্রী আইনজীবী সারা হোসেন।
বার্গম্যান আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত হলে, শহিদুল আলম, তাঁর স্ত্রী রেহনুমা আহমেদসহ আরও ৪৮জন বিবৃতি দেন। এ প্রসঙ্গটিও তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগে উল্লেখ আছে।
পুলিশের অভিযোগে আরও বলা হয়, আইয়ূব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য খান-এ-সবুর শহিদুলের নানীর আপন ছোট ভাই। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর পরিবার ও তিনি খান-এ-সবুরকে আশ্রয় দিয়েছেন। এ ছাড়া শহিদুল মুক্তিযুদ্ধের পর লন্ডন চলে যান।
অভিযোগে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ব্যাংক অফ আমেরিকাসহ যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। তিনি এসব অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থের উৎস সম্পর্কে তথ্য দিতে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন।
এ বিষয়গুলো সম্পর্কে রেহনুমা বলেন, অভিযোগগুলো হাস্যকর পর্যায়ের মিথ্যা।
শুক্রবার সকালে রেহনুমা আহমেদ বেনার নিউজকে বলেন, “দেখুন বাংলাদেশের সোশ্যাল ফেব্রিকই এমন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখেছি আমরা। তার মানে আমাদের মধ্যেই স্বাধীনতাবিরোধীরা ছিলেন।” তিনি বলেন, আত্মীয় পছন্দ করার সুযোগ নেই, দেখতে হবে একজন ব্যক্তি কী আদর্শ নিয়ে চলছেন এবং তাঁর জীবনভাবনা।
“মুক্তিযুদ্ধের পর শহিদুল যখন লন্ডনে পড়তে যায়, তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাঁকে যেতে হয়েছে,” জানান শহিদুলের জীবনসঙ্গী।
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর সঙ্গে শহিদুলকে জড়ানোর নিন্দা করেছেন দৃক গ্যালারির পরিচালক সায়দিয়া গুলরুখ।
“দৃক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে নিজস্ব অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর্কাইভ তৈরির কাজ শুরু করে দৃক। যার ফসল দ্য বার্থ প্যাংস অফ অ্যা নেশন,” সায়দিয়া বেনার নিউজকে বলেন।
তাঁর মতে, এখন না হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ হচ্ছে, কিন্তু দৃক মানে এর প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম এ কাজটি নিজ উদ্যোগে শুরু করেছেন বহু আগে। এমনকি এখনও আমাদের একটা কাজ চলছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
মুক্তি দাবিতে ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিবাদ
দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব, বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী, পবর্তারোহী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা শহিদুলের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়ে চলছেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, মানবাধিকারকর্মী কেরি কেনেডি, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক রাস্তায় নেমে শহিদুলকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানান। গায়ত্রী বলেছেন, শহিদুলের মতো মানুষ কারাগারে আটকে থাকার মানে রাষ্ট্রের বিবেকের মৃত্যু হয়েছে।
শহিদুলের মুক্তির দাবিতে নিউইয়র্কের আকাশে বিমান থেকে বার্তাবাহী ব্যানার উড়িয়েছেন বিশ্বের সর্বোচ্চ সাতটি পর্বতচূড়াজয়ী প্রথম বাংলাদেশি ওয়াসফিয়া নাজরিন। ব্যানারে শহিদুলের নিঃশর্ত মুক্তি চাওয়ার বার্তা লেখা ছিল।
গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে ওয়াসফিয়া বলেছেন, তাঁর মুক্তি চেয়ে ব্যানারটি ম্যানহাটনের আকাশে বিমান থেকে ঝুলিয়ে দেড় ঘণ্টা ধরে ওড়ানো হয়।
এর আগে শহিদুলের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ সিদ্দিক। যদিও শেখ হাসিনার ছেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় শহিদুলককে গ্রেপ্তারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।