‘সাইট ইনটেলিজেন্সে’ ছবি প্রকাশের সূত্র ধরে মিলেছে নিহত জাদুকর সোহেলের পরিচয়

প্রাপ্তি রহমান
2020.09.14
ঢাকা
‘সাইট ইনটেলিজেন্সে’ ছবি প্রকাশের সূত্র ধরে মিলেছে নিহত জাদুকর সোহেলের পরিচয় ঢাকার একটি জঙ্গি আস্তানার কাছে নিরাপত্তাকর্মীদের তল্লাশি। ঢাকা। এপ্রিল ২৯, ২০১৯।
রয়টার্স

গত ৩১ জুলাই ছেলে সোহেল রানার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেছিলেন বাবা আবুল কাশেম মাইজভান্ডারি। পরদিন ছিল ঈদুল আজহা। সোহেল (৩৮) আগের দিন বিকেলেই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল।

“বাড়িতে ঈদ করবে বলে ওই দিনই মোবাইল ফোনে আসার কথা জানিয়েছিল সোহেল রানা, কিন্তু এরপর তাকে খুঁজে পাইনি,” বেনারকে জানান আবুল কাশেম মাইজভান্ডারি।

“ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিতে পুলিশ আমাদের বাড়িতে এসেছিল। ১৫-২০ দিন আগে একবার গাজীপুরের পুলিশ, আরেকবার ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার পুলিশ। কিন্তু কেউ ছেলের লাশটা কোথায় তা বলতে পারল না,” বলেন ওই বাবা। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোহেল রানা গাজীপুরের বরমিবাজারে থাকতেন।

বিশ্বজুড়ে জঙ্গি হামলার খোঁজখবর রাখে সাইট ইন্টেলিজেন্স। সংস্থাটির ওয়েবসাইট গত ১৬ আগস্ট জানানো হয়, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এক জাদুকরকে হত্যা করেছে।

এর প্রায় একমাস পর পুলিশ বলছে, পল্টনে বোমা হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা খুন করেছিল ওই ব্যক্তিকে। নিহত ব্যক্তির নাম সোহেল রানা, এলাকার লোকজন তাঁকে চিনত সোহেল ভান্ডারি নামে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, সিলেট থেকে গ্রেপ্তার দলটি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে।

“সিলেটের এলিগ্যান্ট বাইট অভিযানে গ্রেপ্তার শেখ নাইমুজ্জামান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সোহেলকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে,” সাইফুল ইসলাম বেনারনিউজকে বলেন।

গত ১১ আগস্ট সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শেখ নাঈমুজ্জামানসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি জানায়, হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজারে হামলার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের।

এরপর ১০ সেপ্টেম্বর একই ঘটনায় আরও চারজনকে গ্রেপ্তার দেখায় সিটিটিসি।

নয়জনের এই দলই জাদুকরকে হত্যায় জড়িত ছিল বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। তবে সোমবার পর্যন্ত জাদুকর সোহেল রানার মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি।

সিটিটিসির উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁরা তদন্ত অব্যাহত রেখেছেন।

“গত ১০ সেপ্টেম্বর আমরা যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি, তাদের দুদিনের রিমান্ড শেষ। আবারও চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য,” সাইফুল ইসলাম বলেন।

কে এই জাদুকর

সাইট ইনটেলিজেন্স আইএসের বরাত দিয়ে দুটি ছবি প্রকাশ করেছিল। একটি ছবিতে সোহেল রানার পরনে ছিল গেরুয়া রঙের গেঞ্জি, গলায় মালা ও পরিচয়পত্রের মতো একটা কিছু। মাথা ছিল মুড়ানো। অন্য ছবিতে গেরুয়া রংয়ের পোশাক পরা একজনকে পড়ে থাকতে দেখা যায় তবে চেহারা স্পষ্ট নয়।

সাইট ইন্টেলিজেন্স লিখেছে, রাজধানীর উত্তরে (গাজীপুর) আইএস জঙ্গিরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মূলত ছবিটি প্রকাশের পর থেকেই সিটিটিসি খোঁজখবর করছিল।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে সোহেল রানার স্বজনরা এ খবর জানিয়েছেন। সাইট ইনটেলিজেন্স ছবিসহ খবর প্রকাশের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো গাজীপুরের বরমিবাজারে ছবিটি নিয়ে অনুসন্ধান চালায়।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, সোহেল রানা বরমিবাজার এলাকায় বিচিত্র পোশাক–আশাক পরে আংটি, চুড়ি ও তাবিজ-কবচ বিক্রি করতেন বছর দুয়েক ধরে। তিনি রাতে একটি সেলুনে থাকতেন।

সোহেল রানা কি করতেন জানতে চাইলে তাঁর বাবা বলেন, পারিবারিকভাবেই তাঁরা মাইজভান্ডারি পীরের অনুসারী। ছেলে মাজারে মাজারে ঘুরে তাবিজ-কবচ বিক্রি করত। তিন ছেলের মধ্যে সোহেলই ছিল বড়।

গফরগাঁওয়ের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফয়জুর রহমান জীবন বলেন, সোহেল রানা কেন জঙ্গিদের নজরে পড়লেন তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। সোহেল নিরীহ মানুষ ছিলেন, কোনো ঝুট-ঝামেলায় কখনও জড়াননি।

“সোহেল নিজের মতো থাকত, দু-একমাস পরপর বাড়ি আসত, কয়েকদিন থেকে আবার চলে যেত। এই এলাকার কারও সঙ্গে কখনও ঝগড়া–বিবাদ হয়নি,” ফয়জুর বেনারকে বলেন।

আইএস নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশ সরকার বরাবরই দাবি করে আসছে, দেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের অস্তিত্ব নেই। তবে, সোহেল রানার হত্যা ও ছবি প্রকাশের পর আবারও সামনে এসেছে একই প্রশ্ন। তাহলে কি এখনও বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে?

কথা হচ্ছিল জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদারের সঙ্গে।

“বাংলাদেশে জঙ্গি আছে এবং তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকতে পারে,” মোহাম্মদ আলী শিকদার বেনারকে বলেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা চালায় আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইএসপন্থী এই জঙ্গি সংগঠনকে বলছে নব্য জেএমবি এবং ‘হোম গ্রোন’।

১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে চলা হত্যা ও তান্ডবের ছবিও প্রথম প্রকাশ করেছিল সাইট ইনটেলিজেন্স।

২০১৬ সালের পর থেকে সিটিটিসি ১৭ টি বড় অভিযান চালিয়ে সহস্রাধিক সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে।

 

কারাগারে সতর্কতা জারি

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা লালমনিরহাটের কারাগারে উড়ো চিঠি দিয়ে ও মুঠোফোনে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে কে বা কারা। এই পরিস্থিতিতে দেশের সব কারাগারে সতর্কতা জারি করেছে কারা অধিদপ্তর।

"সপ্তাহখানেক আগে লালমনিরহাট জেল সুপারের কাছে চিঠি আসে, পরে ফোনও। ধর্মীয় উগ্রবাদী একটি দলের পরিচয় দিয়ে তারা তাদের সঙ্গীদের ছিনিয়ে নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে,"  বেনারকে বলেন কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্ণেল মো আবরার হোসেন।

আবরার আরও বলেন, সবাইকে যেকোনো ধরনের হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি