স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা: ভিকারুননিসায় বিক্ষোভ

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.12.04
ঢাকা
181204_Suicide_Aritri_1000.JPG অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় ঢাকার ভিকারুননিসা নুন স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ৪ ডিসেম্বর ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

ঢাকার ভিকারুননিসা নুন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় বের করতে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

একই সাথে অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা সম্পর্কিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মঙ্গলবার এ আদেশ দেয় বলে বেনারকে জানান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনিসহ আরও তিন আইনজীবী বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, “আদালত পাঁচ সদস্যের ওই কমিটিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব, একজন করে শিক্ষাবিদ, মনোবিদ ও আইনবিদকে সদস্য হিসাবে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।”

এই কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাইকোর্ট।

তিনি বলেন, “আদালত আদেশ দেয়ার আগে বলেছে আমাদের শিক্ষকদের মানসিক চিকিৎসা দরকার।”

তাঁর মতে, ওই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে একটি জাতীয় নীতিমালা হবে। ওই প্রতিবেদনে অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ থাকবে।

কেন এই আত্মহত্যা?

গত রোববার নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিষেধ সত্ত্বেও হলে মোবাইল ফোন সঙ্গে নেয় অরিত্রী অধিকারী। শিক্ষকেরা তাকে ধরে ফেলেন। সেদিন তাকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।

স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, অরিত্রী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করেছিল।

অরিত্রীর পরিবার জানায়, সোমবার আবার পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে পরীক্ষা দিতে না দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে ‘অপমান’ করে।

বাবা দিলীপ অধিকারী সাংবাদিকদের জানান, “স্কুল থেকে বলা হয়, অরিত্রীকে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে।”

বাবা-মা ও অরিত্রী মাফ চাইলেও অধ্যক্ষ তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন বলে জানান তিনি।

“এরপর বাসায় ফিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করে অরিত্রী।”

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, গলায় ফাঁস লেগে অরিত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রী দেখতে গেলেন

মঙ্গলবার সকালে ভিকারুননিসা নুন স্কুলের শিক্ষার্থীরা অরিত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্কুল চত্বরে প্রতিবাদ করতে থাকে। শঙ্কা দেখা দেয় বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠান নিয়ে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ স্কুল পরিদর্শনে গেলে উত্তেজিত ছাত্রীরা চিৎকার করতে থাকে। তারা এই ঘটনার বিচার দাবি করে। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে স্কুল চত্ত্বর।

মন্ত্রী স্কুলের অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে কথা বলেন।

তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, “অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা সামান্য বিষয় নয়। সে এতটাই কষ্ট পেয়েছে যে প্রতিবাদে তার জীবন বিসর্জন দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে পারবেন না।”

মন্ত্রী বলেন, “সরকার অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করেছে। এবং এই কমিটি আগামী তিন দিনের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে।”

প্রতিবেদনের আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে জানান মন্ত্রী।

ভিকারুননিসা নুন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুইটি বলেন, “অরিত্রী অপরাধ করলে তাকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হোক। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু বাবা-মাকে ডেকে অপমান করা কি ঠিক?”

এই ঘটনার পর ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজের মূল ক্যাম্পাসের প্রভাতি শাখার প্রধান জিন্নাত আরাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

‘কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না’ সে বিষয়ে উত্তর দিতে তাকে শোকজ করা হয়েছে।

শিক্ষকদের মানবিক হতে হবে

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো কোনো কিছুর প্রতিবাদের ভাষা আত্মহত্যা হতে পারে না। আর সত্য কথা হলো অধ্যক্ষ কিন্তু স্কুলের নিয়মপালন করতে গেছেন। অরিত্রীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল বলে মনে হয় না।”

তিনি বলেন, “স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অর্থাৎ পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি যেভাবে সুরাহা করতে গেছে সেটা সঠিক উপায়ে হয়নি। অনেক সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে সামন্তবাদী আচরণ করে থাকেন স্কুলের শিক্ষকরা। আর মেয়েটি হয়তো তার বাবা-মাকে ডেকে বিষয়টি কঠোরভাবে জানানোকে মেনে নিতে পারেনি।”

ড. হেলাল বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ একটু ভিন্নভাবে বিষয়টি সুরাহা করতে পারত।

এই মনোচিকিৎসক বলেন, “আমাদের দেশের স্কুল-কলেজগুলোকে আরও মানবিক হতে হবে। আর মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।”

ড. হেলাল বলেন, “কেন আত্মহত্যা করা যাবে না-এ বিষয়ে আমি নিজে ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে তিনটি কাউন্সেলিং কর্মসূচি পালন করেছি। আসলে কাউন্সেলিং করে কোনো লাভ হবে না যদি না আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়।”

তিনি বলেন, “মিডিয়ায় এ ধরনের ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করলে অরিত্রীর আত্মহত্যাকে বিরাট একটি অর্জন হিসাবে দেখবে শিশুরা। ফলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।