শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসে তল্লাশি করা হবে: শেখ হাসিনা
কামরান রেজা চৌধুরী ও জেসমিন পাপড়ি
2019.10.09
ঢাকা
2019.10.09
ঢাকা
উচ্ছৃঙ্খলতা ও ‘মাস্তানিতে’ জড়িতদের ধরতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তল্লাশি চালাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর অভিযানে কারও দলীয় পরিচয় দেখা হবে না বলেও সতর্ক করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়া এবং ভারত সফর নিয়ে বুধবার গণভবনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ওই হত্যার প্রতিবাদে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে।
প্রশ্নোত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, “প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিটি হল; শুধু ঢাকা না, সারা বাংলাদেশে প্রত্যেকটা জায়গায় সার্চ করা হবে। সেই নির্দেশটাও আমি দিয়ে দেব।”
পাশাপাশি আবরার হত্যাকারীদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় যা–ই হোক, নিশ্চিত করা হবে সর্বোচ্চ শাস্তি।
উল্লেখ্য, গত রোববার রাতে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। এরপর বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে ছাত্রলীগের প্রভাব ও তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেলে’ পরিণত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ছাত্রলীগসহ ছাত্র সংগঠনের নামে সকল প্রকার গুন্ডামির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।”
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় সারা দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি বার্তা যাবে যে ছাত্র রাজনীতির নামে গুন্ডামির দিন শেষ।”
“তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সর্বোপরি দেশের বিচার বিভাগকে কাজ সঠিকভাবে করতে হবে। অন্যথায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আরেকটি ইস্যুর মাঝে হারিয়ে যাবে,” বলেন তিনি।
ছাত্র রাজনীতির পক্ষে শেখ হাসিনা
আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনের মধ্যে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। বুয়েট শিক্ষক সমিতিও এ দাবির সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। এমনকি শিক্ষক রাজনীতি থেকে বিরত থাকার কথা বলেছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী বুয়েট চাইলে সেখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে পারে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার বিপক্ষে মত দেন তিনি।
তিনি বলেন, “বুয়েটের সিন্ডিকেট আছে, কমিটি আছে তারা যদি মনে করে বন্ধ করে দেবে, আমরা এখানে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি ব্যান করে দিতে হবে এটা তো মিলিটারি ডিকটেটরদের কথা।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশের নেতৃত্ব কিন্তু উঠে এসেছে স্টুডেন্ট পলিটিকস থেকে।... আমি ছাত্র রাজনীতি করেই এখানে এসেছি। দেশের ভালোমন্দ চিন্তাটা ছাত্রজীবন থেকে আছে বলেই আমরা দেশের জন্য কাজ করতে পারি।”
তাঁর মতে, “রাজনীতি একটি প্রশিক্ষণের ব্যাপার। একটি ঘটনা ঘটেছে বলেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা সঠিক নয়।”
শান্তনু মজুমদার বলছিলেন, “প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। তারা রাজনীতি করবে, যেকোনো ধরনের অভিমত প্রকাশ করবে, সংগঠন করবে। এটা সাংবিধানিক অধিকার।,
সেখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার দাবি আত্মহত্যার অনুমতি চাওয়ার শামিল বলে মনে করেন তিনি।
তাঁর মতে, “বুয়েটের ছাত্ররা আসলে এই ধরনের সন্ত্রাসী, গুন্ডা বা ক্ষমতাসীন দল যে ধরনের রাজনীতি করে তা বন্ধ চাইছেন।”
` বাংলাদেশের স্বার্থ বিক্রি হবে না '
সংবাদ সম্মেলনে ভারতের ত্রিপুরায় গ্যাস রপ্তানি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “এলপিজি প্রাকৃতিক গ্যাস নয়, এটা বটল গ্যাস। আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না।”
তিনি বলেন, “যেটা আমরা আমদানি করছি এবং নিজেদের দেশে সরবরাহ করছি এবং সেই গ্যাসই কিছু ত্রিপুরায় দিচ্ছি।’
এ সময় তিনি বলেন, ২০০১ সালে দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করার জন্য কয়েকটি আমেরিকান কোম্পানি ও তাদের রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলেও তিনি রাজি হননি। তবে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে সেবার ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট।
বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ শেখ হাসিনা বিক্রি করবে তা হতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সামান্য ‘খাবার’ পানি দেওয়া হচ্ছে ভারতে
তিস্তা চুক্তি বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকার পরেও ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেওয়া নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা চলছে। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, “ত্রিপুরার সাবরুমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়। এর প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ে। চুক্তি অনুযায়ী মাত্র ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি নেবে।”
“কেউ যদি পানি পান করতে চায়, তা যদি না দিই তা কেমন দেখায়?,” প্রশ্ন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ বন্দর বানিয়ে একা একা ব্যবহার করে না। পৃথিবীতে যত বন্দর আছে সেটা সব দেশ নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে।”
আবরার হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল বুয়েট
টানা তৃতীয় দিনের মতো বুধবারও আবরার হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ছিল বুয়েট। উপাচাের্যর পদত্যাগ ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধসহ ১০ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। দুপুরের পরে তাদের সাথে সংহতি জানান বুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতারা। আবরার হত্যার নিন্দা জানিয়ে নিহতের পরিবারের কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করেন তাঁরা।
কুষ্টিয়ায় বুয়েট উপাচার্য
এদিকে আবরারকে হত্যার দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে না আসলেও নিহতের পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে বুধবার কুষ্টিয়া যান বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তবে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় রায়ডাঙ্গা গ্রামে পরিবারের সদস্যদের সাথে করতে গেলে তোপের মুখে পড়েন ভিসি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফাহাদের কবর জিয়ারত শেষে বুয়েট উপাচার্য ফাহাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে যান। সে সময় উত্তেজিত গ্রামবাসী উপাচার্যকে বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের সাথে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে নিহত আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফায়াজকে ধাক্কা দেয় পুলিশ।
ফায়াজ সাংবাদিকদের বলেন, “আমার ভাইকে তো পিটিয়ে মেরেছে। এবার কি পুলিশ আমাকে মেরে ফেলবে?” তবে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় আবরারের শেষ মুহূর্ত
বুধবার দুপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসে কথা বলেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক দুই ছাত্র আরাফাত ও মহিউদ্দিন। নিহত আবরারের শেষ সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁরা।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে মুমূর্ষু করে ফেলে যাওয়ার পরে আবরার ফাহাদ দেখেছিলেন মহিউদ্দিন। সেই বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, তখনো আবরার বেঁচে ছিল। কাতরাচ্ছিল। কিন্তু তাঁর কাতরানো দেখে মন গলেনি ওদের। বরং সে সময় এক ছাত্রলীগ নেতা বলছিলেন, ‘ও নাটক করতাছে।’
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “আমি জীবিত দেখেও তাঁকে বাঁচাইতে পারি নাই।”
আরাফাত আফসোস করছিলেন কয়েকটি মিনিটের জন্য। তিনি বলেন, “তিন-চার মিনিট আগে যদি আমি সেখানে যেতাম, হয়তো আবরারকে বাঁচানো যেত।”
আরাফাত বলেন, “রাতে খাবার আনতে বের হয়ে দেখতে পাই তোশকের মধ্যে একজন (আবরার) পড়ে আছেন। তখন তাঁর হাত-পায়ে হাত দিয়ে দেখি পুরা ঠান্ডা। শার্ট-প্যান্ট, তোশক ভেজা। মুখ থেকে ফেনা বের হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ওকে বাঁচানোর জন্য বুকে, হাতে চাপ দিই। এরপর ডাক্তার ডেকে আনা হলে তিনি দেখে বলেন, ১৫ মিনিট আগেই সে (আবরার) মারা গেছে।