এবার লক্ষ্মীপুরে পুড়িয়ে এক নারীকে হত্যার অভিযোগ
2019.04.22
ঢাকা
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের জাহান রাফিকে আগুনে পোড়ানোর দু’সপ্তাহ পর এবার পাশের জেলা লক্ষ্মীপুরে এক যুবতীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ঘটনায় চারজনকে আটক করলেও প্রধান অভিযুক্ত পলাতক।
লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলায় রোববার শাহিনুর আক্তার (২২) সোমবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছেন বলে বেনারকে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজে পুলিশ বক্সের ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া।
চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে তিনি জানান, আগুনে শাহিনুরের শরীরের ৪০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। নিহতের শ্বাসনালিও আগুনে পুড়ে গিয়েছিল বলে জানান বাচ্চু মিয়া।
স্বামী সালাহউদ্দিন শাহিনুরের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ।
এর আগে গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির করায় সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মারা যায় রাফি।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পৈশাচিক কায়দায় পর পর দুটি আগুন দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের নারীরা কত বিপদের মধ্যে রয়েছে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “আগুন দিয়ে নারীদের হত্যার ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে সাম্প্রতিককালে এর প্রকোপ বেড়েছে। এর কারণ, এখন রাষ্ট্রে কিছু অপরাধীদের প্রভাব বেড়েছে। দেশে বিচারহীনতা বেড়েছে। আইনের শাসন নেই।”
তিনি বলেন, “এ সকল ঘটনা বন্ধ করতে চাই আইনের শাসন, আইনের সঠিক প্রয়োগ। প্রকৃত দোষীদের বের করে শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় এগুলো বন্ধ হবে না।”
সাবেক মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী ও বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে পাঠ্যক্রমে নারী অধিকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুল থেকেই শুরু করতে হবে। শিশু অবস্থা থেকেই মেয়ে ও নারীদের প্রতি সম্মান দেখানো শেখাতে হবে ছেলেদের।”
প্রধান অভিযুক্ত পলাতক
নিহতের মামা কামাল উদ্দিন বেনারকে জানান, শাহিনুর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন নতুনহাট এলাকার সোনাগাজী গ্রামের মেয়ে। তার বাবার নাম জাফর আহমেদ।
তাঁর ভাগ্নির মৃত্যুর জন্য সালাহউদ্দিন ও তার পরিবারকে দায়ী করেন কামাল উদ্দিন।
এই আগুন দেওয়ার ঘটনায় স্বামী সালাহউদ্দিনের দুই ভাই, একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চৌকিদারকে আটক করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন। তবে স্বামী সালাহউদ্দিন পলাতক বলে জানান তিনি।
ইকবাল হোসেন বলেন, “নিহত শাহিনূরের গায়ে কে আগুন দিয়েছে, কখন দিয়েছে, কীভাবে দিয়েছে এগুলো আমরা তদন্ত করছি। তদন্তের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
তবে নিহতের বাবা ও মামা সোমবার রাতে সালাহউদ্দিনকে দায়ী করে মামলা করেছেন বলে জানান তিনি।
আগুন দেওয়ার কারণ
বেনারের কাছে কামাল উদ্দিনের দেওয়া বর্ণনানুযায়ী, দুই বছর আগে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শাহিনুরের সাথে পরিচয় হয় লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের পাটারিরহাট এলাকার মোহর আলীর ছেলে সালাহউদ্দিনের। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রেমের কয়েক মাস পর রাউজানে তাদের বিয়ে হয়।
কিন্তু বিয়ের পর শাহিনুরকে লক্ষীপুরের তার বাড়িতে নিয়ে যায়নি সালাহউদ্দিন। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য শুক্রবার রাতে নিজেই শ্বশুরবাড়ি হাজির হন শাহিনুর।
সেখানে গিয়ে শাহিনূর দেখেন সালাহউদ্দিন বিবাহিত এবং তার দুই সন্তান আছে। তিনি স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করলে সালাহউদ্দিন তা অস্বীকার করেন। বিষয়টি সুরাহার জন্য শাহিনূর দু’দিন ধরে এলাকার বিভিন্ন মানুষের কাছে আকুতি জানান। গ্রামে ভিড় জমে যায়।
সালাহউদ্দিন ও তার ভাইয়েরা এলাকা থেকে চলে যাওয়ার জন্য শাহিনুরকে হুমকি দেয়। তবে তিনি এলাকা ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
রোববার স্থানীয় চরফলকন ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মো. হাফিজ উল্যাহ ও গ্রাম পুলিশ আবু তাহের বিষয়টি সুরাহা করে দেবেন শাহিনুরকে আশ্বাস দেন। কিন্তু তারা বিষয়টি সুরাহা করেননি।
হাসপাতালে নেওয়ার পর অগ্নিদগ্ধ শাহিনুর সাংবাদিকদের জানান, রোববার বিকেলে সালাহউদ্দিনের বাড়ির পাশের একটি সয়াবিন ক্ষেতে শাহিনুরকে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন সালাহউদ্দিনের লোকজন।
ইউপি মেম্বার হাফিজ উল্যাহ সাংবাদিকদের জানান, সালাহউদ্দিনের সাথে বিয়ের স্বপক্ষে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি শাহিনুর।
তিনি বলেন, “আমরা তাকে বিয়ের কাগজপত্র নিয়ে আবার দেখা করার কথা বলে ফিরিয়ে দেই। ফিরিয়ে দেওয়ার কিছু সময় পরেই আমরা খবর পাই তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় কমলনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করে দেই।”
পুড়িয়ে মারার ঘটনা বাড়ছে
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে সাম্প্রতিককালে নারীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের নির্যাতন বাড়ছে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০১৭ সালে মোট ৪৪২টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আগুন দিয়ে দেওয়ার ঘটনায় প্রাণ হারায় ২৭০ নারী।
যৌন হয়রানি বন্ধে কমিটি করার নির্দেশ
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর যৌণ হয়রানি বন্ধে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করতে নির্দেশনা জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ শাহেদুল খবির চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০০৯-১০ সালে আদালতের একটি নির্দেশনার প্রেক্ষিতে সারা দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বিরোধী কমিটি গঠন করা হয় বলেন বেনারকে জানান দেশের শীর্ষ শিক্ষা বিষয়ক সংবাদমাধ্যম দৈনিক শিক্ষা ডটকমের সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান খান।
তিনি বলেন, “দু:দুঃখের বিষয় হলো, ওই কমিটিগুলো কোনো কাজ করে না। সরকারের উচিত, কমিটিগুলো কেন কাজ করে না সেই কারণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।”