প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে ত্রুটি ঘটনায় অভিযুক্তরা রিমান্ডে
2016.12.22
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ফ্লাইট জরুরি অবতরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অভিযুক্ত নয় কর্মকর্তার সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
ওই বিশেষ বিমানে ত্রুটির বিষয়টি ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, তা নিশ্চিত হতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে ওই ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্রের চেয়ে বিমান কর্মীদের অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
গত মঙ্গলবার রাতে বিমানবন্দর থানায় নয় জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। বুধবার রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এদের সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আসামিদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে তাঁদের পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করা হয়।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলেও বিচারক সাতজনের প্রত্যেককে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আসামিদের বাকি দুজন পুলিশের হাতে আটক না হলেও বৃহস্পতিবার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে তা নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠায় আদালত। এই দুজনকেও বাকিদের সঙ্গে রিমান্ডে নেওয়া হবে বলে বেনারকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি আব্দুল্লাহ আবু।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বেনারকে বলেছেন, “অপরাধীদের খুঁজে বের করতে বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স মামলা করেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে।”
পুলিশের হেফাজতে থাকা কর্মকর্তারা হলেন; বিমানের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (প্রোডাকশন) দেবেশ চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) এস এ সিদ্দিক, ভারপ্রাপ্ত মুখ্য প্রকৌশলী (এনসিসি) বিল্লাল হোসেন, প্রকৌশল কর্মকর্তা লুৎফর রহমান, সামিউল হক, মিলন চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসাইন, এস এম রোকনুজ্জামান ও জুনিয়র টেকনিশিয়ান মো. সিদ্দিকুর রহমান।
মামলার এজাহারে অভিযোগ আনা হয়, “এসব আসামি পরস্পর যোগসাজশে ষড়যন্ত্র করে ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রুটি ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। তারা ষড়যন্ত্র করে যন্ত্রপাতি ত্রুটি করে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালিয়েছে।
গত ২৭ নভেম্বর হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে (বোয়িং ৭৭৭) যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। ফ্লাইটটি তুর্কমিনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদ বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়।
সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় চার ঘণ্টা অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করতে হয়। সেখানেই বিমানের ত্রুটি মেরামত করার পর আবার সেটি হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা হয়।
এর পেছনে নাশকতা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান মন্ত্রণালয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তিন কমিটির প্রতিবেদনেই ঘটনাটি মানবসৃষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়।
বিমানের প্রকৌশল শাখাসহ প্রতিটি স্তরে অদক্ষতা ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের কমিটি প্রকৃত ঘটনা খতিয়ে দেখতে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করে। ওই সুপারিশে মামলা করার ব্যাপারে গত ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি পাওয়া যায়।
মঙ্গলবার রাতে বিমানবন্দর থানায় নয় জনকে আসামি করে মামলা করেন বিমানের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট) এস এম আসাদুজ্জামান।
এর আগে তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে দুই দফায় বিমানের নয়জন প্রকৌশলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বিমানকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ
অদক্ষ কর্মচারি আর পুরোনো সিস্টেমের কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। বরং ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাই এ প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহি চৌধুরী বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার ফল। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তারা টিকতে পারছে না।”
তাঁর মতে, “এ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অনেক বেশি। যাদের বেশিরভাই অদক্ষ, অথচ তাদেরকে কেউ কিছু করতেও পারে না। ফলে দায়িত্বহীনতা বাড়ছে।”
এমন অবস্থায় পুরো বিমানকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন ইশফাক ইলাহি চৌধুরি।
এদিকে বিমানের নানা সমস্যা রয়েছে স্বীকার করে বিমান মন্ত্রী বেনারকে বলেন, “সেগুলো সমাধানের চেষ্টা রয়েছে। এখানে দক্ষ জনবলের অভাব যেমন আছে, তেমন রয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবও। বিদ্যমান সব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী শিগগিরিই একটি কমিটি গঠন করা হবে।”
এবার চাকা ফাটলো বিমানের
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের ত্রুটি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার মাঝেই এবার উড়ন্ত অবস্থায় অন্য একটি উড়োজাহাজের চাকা ফেটে যাওয়ায় নতুন বিপত্তিতে পড়েছে বাংলাদেশ বিমান। ওমানের মাসকট থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে চাকা ফাটার কারণে উড়োজাহাজটি ঢাকায় জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়। ফ্লাইটের সব যাত্রী এবং ক্রু সুস্থ ও নিরাপদ আছেন।
এ প্রসঙ্গে বিমানের জনসংযোগ শাখার জিএম শাকিল মেরাজ সাংবাদিকদের জানান, “এ ঘটনা তদন্তে বিমানের ডেপুটি চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন এনামকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।”
এক বিজ্ঞপ্তিতে বিমান জানায়, “নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই ফ্লাইট ক্যাপ্টেন চট্টগ্রামের পরিবর্তে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপদে অবতরণ করেন।”