অভিজিৎ হত্যা: অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হলেও বিচার শুরু হয়নি

প্রাপ্তি রহমান
2019.02.26
ঢাকা
190226_AVIJIT_MURDEr_1000.JPG অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের চার বছর পূর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অভিজিৎ হত্যার স্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে অজয় রায় তাঁর বড়ছেলে অভিজিৎ রায়ের ছবির সামনে ফুল রেখেছেন। কটা মোমবাতি জ্বেলেছেন। বললেন, চারটি মৃত্যুবার্ষিকীতে এভাবেই স্মরণ করেন ছেলেকে।

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের চার বছর পার হলো মঙ্গলবার। তাঁর বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বেনার নিউজের।

অনাবাসী লেখক অভিজিৎ ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় খুন হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যেই বইমেলায় এ ঘটনা ঘটে। আল কা‌য়েদাপন্থী নি‌ষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলাম হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় বলে জানায় পুলিশ।

এর আগে একই কায়দায় হামলায় ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ূন আজাদ।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র পুলিশ অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, তবে এখনও বিচার শুরু হয়নি।

“আগে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ছেলেরা সভা করত, মিছিল করে শহীদ মিনারে যেত। ওরা আর কত করবে? ধৈর্যের একটা সীমা আছে তো,” বলছিলেন অজয় রায়।

তিনি বলেন, পুলিশ জানিয়েছে তারা অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি জানেন না। বিচার হবে কি না হবে, কবে হবে সেটা এখন সরকারের হাতে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, চার বছরে মাত্র অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হওয়ার অর্থ অত্যন্ত ধীর গতিতে এগুচ্ছে সবকিছু।

“অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সবকিছু বেশ ধীর গতিতে এগুচ্ছে। তাই পুরো বিচারকাজ শেষ হতে আরো অনেক সময় লাগবে,” বেনারকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, “তদন্ত থেকে শুরু করে সব কিছু দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে গেলো। চার বছর লাগলো শুধু চার্জশিট দিতেই। সেখানে খুব তাড়াতাড়ি বা কয়েকদিনের মধ্যেই ফল আশা করা যাচ্ছে না।”

অভিযোগপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম গত ১৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করে। এর মধ্যে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ আদালতে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠায়।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের চিঠি এখনও তাঁরা হাতে পাননি বলে বেনারকে জানান ডিএমপির মুখপাত্র উপপুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান।

যা আছে অভিযোগপত্রে

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগপত্র সম্পর্কে বিবরণ দেন।

তিনি জানান, প্রায় চার বছর তদন্ত শেষে ছয়জনকে অভিযুক্ত করে পুলিশ অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করে। এই অভিযুক্তদের চারজন গ্রেপ্তার হন। তাঁরা হলেন মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (সাংগঠনিক নাম শাহরিয়ার), মো. আবু সিদ্দিক সোহেল (৩৪) ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব (সাংগঠনিক নাম সাকিব, সাজিদ, শাহাব), মো. আরাফাত রহমান (সাংগঠনিক নাম- সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ) (২৪) ও হত্যাকাণ্ডে উস্কানি বা প্ররোচনাদানকারী শাফিউর রহমান ফারাবী (২৯)।

গ্রেপ্তারকৃতদের সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

মামলার পলাতক আসামী দুজন। তাঁরা হলেন, পরিকল্পনাকারী সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া (চাকুরিচ্যুত মেজর)। তাঁর সাংগঠনিক নাম- সাগর, বড় ভাই (৪২) ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে হাসিবুল ওরফে আব্দুল্লাহ (৩০)।

পুলিশ হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। সন্দেহভাজন বাকি পাঁচ আসামির শুধুমাত্র সাংগঠনিক নাম জানা গেছে। পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা না পাওয়ায় ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন তাঁরা। গ্রেপ্তার হলে সম্পূরক ভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ‘অপারেশনাল কমান্ডার’ মো. মুকুল রানা ওরফে শরিফুল ইসলাম ওরফে হাদী পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

পুলিশ যা জেনেছে

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম জানান, “ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ায় উগ্রপন্থীদের হামলার শিকার হন অভিজিৎ রায়। তাঁকে হত্যার জন্য হত্যাকারীরা উত্তরা ও এলিফ্যান্ট রোডে অপারেশনাল হাউজ ভাড়া করেছিল।”

তিনি আরও বলেন, বই মেলা উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসা অভিজিৎ রায়কে হত্যাকারীরা ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে।

চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তিনি এখন কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, “সে গা ঢাকা দিয়েছে। কিছুটা নিষ্ক্রিয়। সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের পর তার কোনো কর্মকাণ্ডের খবর সেভাবে পাওয়া যায়নি।”

অভিজিৎ রায়কে স্মরণ

মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের চতুর্থ বার্ষিকীতে মুক্তমনা ব্লগ তাঁর স্মরণে পোস্ট করেছে। মুক্তমনা বলছে, তিনিই বাংলা ভাষায় স্পষ্টভাবে লিখেছেন বিজ্ঞান আর অ-বিজ্ঞানের পার্থক্য। তিনি’ই দেখিয়েছেন কোনো কিছুর ঐশ্বরিক ব্যাখ্যার কোনো মানে হয় না, ঈশ্বর একটি বাড়তি হাইপোথেসিস মাত্র।

“এটা একদিকে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল সত্য সন্ধানীদের কাছে, সংশয়বাদীদের কাছে, অপরদিকে তিনি এক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ছদ্মবিজ্ঞানের আশ্রয়ে থাকা অন্ধকারের ফেরিওয়ালা ও ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে,” মুক্তমনার সম্পাদক লিখেছেন।

টিএসসিতে তাঁর স্মরণে সন্ধ্যার কিছু আগে জড়ো হন পাঠক ও প্রকাশকেরা। মুক্ত চিন্তার পক্ষে শাহবাগে স্লোগানে তাঁরা বলছেন, ‘অভিজিৎ রায়েরা হারলে হারবে বাংলাদেশ’।

শ্রাবণ প্রকাশনী প্রকাশক রবিন আহসান ফেসবুকে তাঁর কাভার ফটো করেছেন অভিজিৎ রায়কে নিয়ে তৈরি ব্যানারের ছবি দিয়ে। তাতে লেখা ‘আমাদের স্মরণ আছে, সেই অন্ধকার রাতের কথা’।

অভিজিৎকে স্মরণ করেছেন তাঁর ভক্ত–অনুরাগী ও পাঠকেরা।

ধীর গতিতে চলছে অন্য ব্লগার হত্যার বিচার

এখন পর্যন্ত লেখালেখির কারণে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে ছয়জনকে। তাঁদের মধ্যে আহমেদ রাজীব হায়দার ও ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়েছে। এর বাইরে অনন্ত বিজয় দাস হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য ফিরিয়ে দিয়েছে সেটি।

বাংলাদেশে ব্লগার হত্যার শুরু ২০১৩ সাল থেকে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তখন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ উত্তাল। মঞ্চের অন্যতম সংগঠক আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় আনসার আল ইসলামের ‘টার্গেট কিলিং’। দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ রাজীবের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে এখন।

বছরখানেক বিরতির পর ২০১৫ সাল থেকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড  চলতে থাকে। এ দফায় প্রথম শিকার অভিজিৎ রায়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ খুনের একমাসের মাথায় খুন হন ওয়াশিকুর রহমান বাবু। ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের বিচারও শুরু হয়েছে।

এরপর একই বছরে খুন হন সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অনন্ত বিজয় দাস, ঢাকার পূর্ব গোড়ানে নিলাদ্রী নিলয় এবং ঢাকার শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন। পরের বছর ৬ এপ্রিল নাজিমুদ্দীন সামাদ খুন হন।

এঁদের প্রত্যেকেই নিহত হন চাপাতির কোপে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।