মুক্তচিন্তার বইয়ে পুলিশি নজরদারি, আতঙ্কে লেখক-প্রকাশক
2017.02.01
অমর একুশে বইমেলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে—এমন বই প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে এক ধরনের হুমকি আসায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন লেখক ও প্রকাশকদের অনেকেই।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাসব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করেছেন, যে মেলায় তাঁর নিজের লেখা একটি বইও প্রকাশ হয়েছে।
এবার মেলা শুরুর কয়েকদিন আগে থেকেই বইয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে—এমন বই কোনও স্টলে না রাখার জন্য লেখক-প্রকাশকদের অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
“এমন কোনো বই যাতে বইমেলায় ঢুকতেও না পারে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে,” গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান পুলিশ কমিশনার।
ডিএমপি কমিশনার আশ্বস্ত করেন, “পুলিশের নজরদারি মুক্তিচিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। কিন্তু মুক্তচিন্তা করতে গিয়ে কেউ যদি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেন, গোষ্ঠীগত দাঙ্গা সৃষ্টিতে উসকানি দেন, কারও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেন তাহলে সেটা মুক্তচিন্তার মধ্যে পড়ে না।”
এর একদিন আগে সোমবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন কোনো বই মেলায় আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার কাজ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আতঙ্ক ও ক্ষোভ
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশ ও বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা হচ্ছে।
“বইয়ের ওপর নজরদারি বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশ কোনও কর্তৃপক্ষ নয়। তাই পুলিশের নতুন এই তৎপরতায় আমরা উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত,” জানিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক হারুন উর রশীদ।
বেনারকে তিনি বলেন, “এর মধ্য দিয়ে প্রকাশক ও লেখকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাদের সেলফ সেন্সরে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে মুক্তচিন্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে,” মত দেন হারুন উর রশীদ।
শ্রাবণ প্রকাশনীর মালিক রবীন আহসান বেনারকে বলেন, “বইয়ে কী থাকবে, কী থাকবে না—এ রকম নিয়ন্ত্রণ পুলিশ আরোপ করতে পারে না। আমরা এর নিন্দা জানাই।”
মুক্তচিন্তার বই ঘিরে খুন ও নিষেধাজ্ঞা
বইমেলায় মুক্তচিন্তার বই প্রকাশের ওপর বারবার বাধা দিয়ে আসছে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশের নজরদারি। গত কয়েক বছর থেকে বই মেলায় বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা চলে আসছে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ড. অভিজিৎ রায়কে বইমেলা থেকেই টার্গেট করেছিল জঙ্গিরা। মেলা থেকে বেরিয়ে কয়েকশ’ গজ যাওয়ার পরপরই তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
ওই বছর অক্টোবরে অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকেও হত্যা করে উগ্রপন্থীরা। তাঁর মালিকানাধীন জাগৃতি প্রকাশনী অভিজিতের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি প্রকাশ করেছিল।
দীপনকে হত্যার দিন অভিজিতের বইয়ের আরেক প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। টুটুলের সঙ্গে থাকা কবি তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুকেও কোপানো হয়। অভিজিৎ রায়ের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’সহ কয়েকটি বই বের করেছিল শুদ্ধস্বর।
একই বছর ইরানের লেখক আলী রাশদীর বাংলায় অনুদীত ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ বইটি মেলায় নিষিদ্ধ করা হয়। বইটির প্রকাশক রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় মেলা কর্তৃপক্ষ।
এর আগে ২০০৪ সালে প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকেও আক্রমণ করা হয়েছিল মেলা থেকে বের হওয়ার পর।
২০১৬ সালের বই মেলা থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। বইয়ের লেখক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকসহ চারজনকে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করায় রবিন আহসানের শ্রাবণ প্রকাশনীকে এবার শুরুতেই স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। পরে লেখক-প্রকাশকদের প্রতিবাদের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শেষ পর্যন্ত শ্রাবণকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
লেখক ও প্রকাশকেরা বলছেন, বইয়ের ওপর নজরদারি করা এবং কোনটা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এবং কোনটা আঘাত করে না—এটা নির্ধারণ করার মতো জনবল ও দক্ষতা পুলিশের নেই।
মূলত ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো যেসব বই সম্পর্কে আপত্তি জানাবে, সেগুলোর বিরুদ্ধে পুলিশ ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে বলে তাঁরা মনে করছেন।
বুধবার বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি লেখায় লেখক ও সাংবাদিক হারুণ উর রশিদ প্রশ্ন করেন, বইমেলা উপলক্ষে প্রতিবছর কমবেশি চার হাজার বই প্রকাশিত হয়। পুলিশ কি সব বই পড়বে? এক মাসের মধ্যে হাজার হাজার বই পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো জনবল ঢাকা মহানগর পুলিশের কি আছে?
তবে পুলিশের এই নজরদারি এবং ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বেনারকে বলেছেন “জঙ্গি হুমকি সামাল দেওয়ার অংশ হিসেবে সরকার কোনও কোনও ক্ষেত্রে মত প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও তাতে সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে।”
এই নিয়ন্ত্রণের আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, “দণ্ডবিধিতে ধর্মীয় অনুভূতি সংক্রান্ত একটি বিধান আছে। সেটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তবে পুলিশ কিংবা বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের এসব ভূমিকার আইনগত ভিত্তি নেই বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, “দণ্ডবিধিতে যা আছে তা পুলিশ প্রয়োগ করতে পারে যদি কেউ মামলা করে সেক্ষেত্রে। কিন্তু প্রকাশনার ওপর নজরদারি করার এখতিয়ার তাদের নেই।”
তাঁর মতে, বই লেখা পুলিশের আমলযোগ্য অপরাধ নয়। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ ব্যাবস্থা নিতে পারে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কথা বলতে চাননি দেশের সংবিধান প্রণেতা প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম। অথচ তিনিই এক সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৯৫ সালে সরকার হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে লড়েছিলেন ব্যারিস্টার আমির।
কথোপকথনের এক পর্যায়ে প্রখ্যাত ওই আইনজীবী বেনারকে বলেছেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার যদি মনে করে এটা করা দরকার, তাহলে আমি তা সরাসরি নাকচ করে দেবো না। তবে বিশেষ কোনো বইয়ের উপর আঘাত এলে সেজন্য আইনি লড়াই করতে রাজি আছি।”