ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ নাকচ

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক ও প্রাপ্তি রহমান
2017.01.05
চুয়াডাঙ্গায় বিজিবি ও বিএসএফের পতাকা বৈঠক। চুয়াডাঙ্গায় দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক। জানুয়ারি ০৫, ২০১৭।
স্টার মেইল

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার মনে করেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ভেতরে সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় এখনো বিদ্রোহীদের কিছু ঘাঁটি রয়েছে। এসব ক্যাম্প থেকে ভারতের ক্ষতি সাধন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম বৃহস্পতিবার মানিক সরকারের এই বক্তব্য প্রকাশ করেছে। তবে বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কোনো প্রকার উপস্থিতির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

বেনার নিউজকে আসাদুজ্জামান বলেছেন, “বাংলাদেশে ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শিবির আছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তারক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে।”

গত বুধবার আগরতলায় পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্যারেড পরিদর্শনের পর মানিক সরকার বলেন, “বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায়, তাদের উৎপাত আগের চেয়ে কমেছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ সীমান্তের ওপারে এখনো কিছু শিবির রয়ে গেছে। জঙ্গিরা বাংলাদেশের নিরাপত্তারক্ষীদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল ব্যবহার করছে। যদিও এরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়, তারপরও ক্ষতি করতে এরা শক্তি সঞ্চয় করছে।”

প্রায় একই ভাষায় কথা বলেছেন ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশের মহাপরিচালক কে নাগ্রা। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের গহিন অঞ্চলে এখনো কিছু ক্যাম্প রয়েছে।”

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন এ রকম ব্যক্তিবর্গও মনে করেন যে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এখানে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্থায়ী ক্যাম্প থাকা অসম্ভব। তবে পাহাড় ও গহিন জঙ্গলে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর লোকজন আশ্রয় নেওয়া এবং সাময়িকভাবে লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত ব্যাপার নয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বেনার নিউজকে বলেন, “বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের দমন তৎপরতায় কোনো ঘাটতি নেই। ভারত ও বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কেও বর্তমানে কোনো ঘাটতি নেই।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার এখানকার ভূমি ব্যবহার করে কোনো জঙ্গি তৎপরতা সহ্য করে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সুতরাং সেখানকার জঙ্গিদের কোনো স্থায়ী ঘাঁটি থাকার সম্ভাবনা আমি দেখি না।”

সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সমতল এলাকায় জঙ্গি ঘাঁটি থাকার সম্ভাবনা একেবারেই অসম্ভব। কারণ বাংলাদেশের বাহিনীসমূহ তাদের কঠিনভাবে মোকাবিলা করছে। তবে পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর লোকজন সাময়িকভাবে লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে।

আবদুর রশীদ বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে ত্রিপুরার যে সীমান্ত এলাকা সেটি গহিন অরণ্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেখানে সন্ত্রাস দমনে কাজ করেছি। ওই গহিন অরণ্যে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষী ও সেনা সদস্যরা তবুও আন্তরিকভাবে সেখানে কাজ করছে। সেখানে বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপস্থিতি প্রবল। তারপরও গহিন জঙ্গলে তারা সাময়িকভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে।”

“আমার জানামতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি কোনো প্রকার সহযোগিতামূলক মনোভাব বাংলাদেশের নেই,” জানান ওই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “আমি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে পলিটিক্যাল রেটোরিক হিসেবেই দেখছি। যেখানে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন সেখানে তাদের জনগণকে একটা বুঝ দিতে হয়। তারা সম্ভবত: নিজেদের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার দায় আরেক দিকে চাপিয়ে পার পেতে চেয়েছেন।”

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর চেয়ারম্যান মুন্সী ফায়াজ আহমেদ ত্রিপুরা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল কথা হলো, বাংলাদেশ কখনো তার ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এমন কাজে ব্যবহার করতে দেবে না। এই নীতি শুধু কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ নেই। নীতির বাস্তবায়ন হওয়ায় ভারতের সঙ্গে আগে যে টানাপোড়েন ছিল সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। তারপরও প্রতিবেশী দেশ মাঝে মাঝে এমন আওয়াজ তোলে, যে আওয়াজটা না তোলাই ভালো।”

সীমান্তবর্তী ভারতের সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতে হামলা করছে—এমন অভিযোগ উঠেছে আগেও। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্ত নিকটবর্তী এলাকায় আশ্রয় নেওয়া বেশ কিছু ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে ভারতের হাতে তুলেও দিয়েছে বাংলাদেশ।

ভারতের ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (এনএলএফটি) এবং অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ) বাংলাদেশের ভেতরে গোপন আস্তানা করে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে—এই অভিযোগ বেশ পুরানো। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দুটি সংগঠন নিষিদ্ধ করেছে। এটিটিএফ এর সদস্যদের বড় অংশ আত্মসমর্পণ করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্য সংগঠনগুলো সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বেনার নিউজকে বলেন, “কোন তথ্যের ভিত্তিতে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী এ রকম কথা বলেছেন তা তিনিই জানেন। আমি এটা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি, যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের মাটিতে স্থান না দেওয়ার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শতভাগ নিষ্ঠাবান।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, “এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। তথ্যের আদান প্রদান এবং সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে অবস্থান করে কোনো গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে পারে এটা আমার মনে হয় না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।