ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিহতদের সবাই অপরাধী: বিএসএফ
2022.07.21
ঢাকা

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশিদের সবাইকে অপরাধী বলে মন্তব্য করেছেন বিএসএফ মহাপরিচালক (ডিজি) পঙ্কজ কুমার সিং।
বাহিনীটির এই শীর্ষ কর্মকর্তা মনে করেন, নিহত ব্যক্তিদের সবাই মাদক কারবারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং এ কারণে গোলাগুলির ঘটনা রাতেই ঘটেছে।
অপরদিকে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা না গেলে দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে যে পেশাদার সম্পর্ক, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ।
বৃহস্পতিবার পিলখানাস্থ বিজিবি সদর দপ্তরে আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী ৫২তম সীমান্ত সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন বিএসএফ ও বিজিবি মহাপরিচালক।
সংবাদ সম্মেলনে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কীসের ভিত্তিতে অপরাধী বলছেন এবং তাঁদের শরীরের ওপরের অংশে গুলি লাগার পরও কেন এটা টার্গেটেড কিলিং বলা হবে না-এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার বলেন, “জুডিশিয়াল সিস্টেমে কোনো অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাউকে অপরাধী বলতে পারি না। আমরা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাথে কথা বলি, কলকাতা পুলিশ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করি। আমরা গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করি এবং এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা নিশ্চিত হই যে, তাঁরা দুই দেশের সীমান্তে চোরাকারবারে জড়িত মাফিয়া।”
সীমান্তবর্তী দুই এলাকাতেই ভালোমন্দ মানুষ আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, খারাপ লোকদের কারণে সীমান্তে অপরাধ সংঘঠিত হয়। তাঁদের কারণেই চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশের মতো ঘটনা ঘটে।
বিএসএফ প্রথমে ‘নন লেথাল’ অস্ত্র ব্যবহার করে জানিয়ে তিনি জানান, যাতে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যু না হয়, সে বিবেচনাতেই ‘নন লেথাল’ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
প্রতিবার সীমান্ত সম্মেলনে হত্যা বন্ধের আলোচনা হলেও হত্যা বন্ধ হচ্ছে না, এমনকি গত জুন মাসেও সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন পাঁচজন- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসএফ মহাপরিচালক বলেন, “এ প্রশ্ন আমাদের প্রতিবছরই শুনতে হয়। বিজিবি ও বিএসএফ খুবই পেশাদার বাহিনী। তবে আমাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ভিন্ন, পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়েও আলাদা। সীমান্ত হত্যা কীভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করি।”
সীমান্তে হত্যা কমিয়ে কীভাবে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা যায়, তার উপায় নিয়ে বিএসএফের সাথে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদানের বিষয় নিয়ে এ সম্মেলনে আলোচনা করেছি।
“এ ছাড়াও আমরা যোগাযোগ ও যথাযোগ্য সময়ে তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে, আন্তঃসম্পর্কের উন্নতি এবং ফরমাল ও ইনফরমাল সম্পর্ক জোরদারে উদ্যোগী হতে আলোচনা করেছি,” বলেন সাকিল।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে বিএসএফ ডিজির বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সাকিল বলেন, সীমান্তে একটা হত্যা মানে শুধু একটা মানুষের মৃত্যু নয়, এতে নিহতের পুরো পরিবার ভোগে। এলাকার মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে যে পেশাদার সম্পর্ক, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
“এসব আমরা বিএসএফকে বুঝিয়েছি। তাঁরাও বুঝেছেন। আমরা সব সমস্যা একীভূত করে ধীরে ধীরে সেগুলো শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাই। আমাদের যে স্পিরিট সেটা কাজে লাগাতে পারলে এটা সম্ভব বলে আমরা আশাবাদী,” যোগ করেন বিজিবি প্রধান।
ভারত থেকে বিভিন্ন সময় বেশকিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, দালালচক্রের তৎপরতা কীভাবে প্রতিহত করা যায়, তা নিয়ে সীমান্ত সম্মেলনে বিস্তারিত কথা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন ভারত সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বিএসএফকে সীমান্তে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বলেছে বিজিবি।
সীমান্তে সহিংসতা কমাতে ঐকমত্য
সম্মেলন শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সীমান্তে আক্রমণ ও হামলার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তে সমন্বিত যৌথ টহল পরিচালনাসহ অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি জোরদার করা, সীমান্ত এলাকায় বসবাস করা নাগরিকদের মাঝে আন্তর্জাতিক সীমানা আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের ব্যাপারে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে।
বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্ত হত্যার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি সীমান্ত হত্যার পাশাপাশি মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান, মানবপাচার, অবৈধ সীমান্ত পারাপার এবং সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং এসব অপরাধ দমনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসএফের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্তে বিভিন্ন অপরাধ, মাদক চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধের পাশাপাশি কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণসহ ভারতীয় পার্শ্বে অনিষ্পন্ন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (সিবিএমপি) ওপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পণ্যসামগ্রী পাচার যেমন– মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য (বিশেষ করে ইয়াবা), আগ্নেয়াস্ত্র, জাল মুদ্রা, স্বর্ণ চোরাচালানসহ বিভিন্ন ধরনের সীমান্ত অপরাধ দমনের লক্ষ্যে সিবিএমপি বাস্তবায়ন এবং উভয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী উপকৃত হবে এমন তথ্য আদান-প্রদানে দু’পক্ষ সম্মত হয়েছে, বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
বিএসএফ ডিজির বক্তব্য সত্য আড়ালের চেষ্টা
সীমান্ত হত্যার শিকার সবাই অপরাধী-বিএসএফ প্রধানের এই বক্তব্যকে সত্য আড়ালের চেষ্টা বলে মনে করেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।
“কোনও আদালত কতৃক নির্ধারিত হবার আগে কাউকেই অপরাধী বলা যায় না, এটা কোন দেশেই যায়না। অথচ বিএসএফ প্রধান বললেন সীমান্ত হত্যার শিকার ব্যক্তিরা সবাই অপরাধী, এটা মানবাধিকারের চরমতম লঙ্ঘন,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে সীমান্ত হত্যা চালু আছে এবং এই ধরনের প্রতিটি বৈঠকেই সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, তবে হত্যা থামছেই না।
“বৈঠকে দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি আন্তরিক না হতে পারলে এসব বৈঠক কার্যত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছুই নয়,” যোগ করেন এই মানবাধিকারকর্মী।
থেমে নেই সীমান্ত হত্যা
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছেরের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ২৩জন বাংলাদেশি নিহত হবার ঘটনা ঘটেছে।
নিহতদের বেশিরভাগই বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে দাবি এই মানবাধিকার সংগঠনটির।
অপর মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে এক হাজার ২৫৩জন বাংলাদেশি।
“গত ১০ বছরের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি নারী ও শিশুরাও বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, যা মানবাধিকার ও সীমান্ত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন,” বলেন নূর খান।
সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ ৯ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেন।
অপরদিকে বিজিবি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যৌথ নদী কমিশন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, সার্ভেয়ার জেনারেল অব বাংলাদেশ এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিসহ ২০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন।