বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.11.05
ঢাকা
191105_Alice_Wells_Visit-1000.jpg স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে তাঁর দপ্তরে সাক্ষাত করেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস জে. ওয়েলস (ডানে)। ৫ নভেম্বর ২০১৯।
[সৌজন্যে: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়]

বঙ্গোপসাগর উদ্যোগের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে সামরিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করতে চায় বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন দেশটির সফররত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস জে. ওয়েলস।

চীন থেকে ডুবোজাহাজ কেনার পর চীনা সহয়তায় ডুবোজাহাজ ঘাঁটি নির্মাণে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেলো বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার ব্যাংকক থেকে তিন দিনের বাংলাদেশ সফরে ঢাকা আসেন ওয়েলস। ওই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে সাক্ষাত করে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাস বিরোধী সহযোগিতা বৃদ্ধি, মানবপাচারসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনা হয় বলে সাংবাদিকদের জানান ওয়েলস।

বঙ্গোপসাগর উদ্যোগ ছাড়াও বাংলাদেশের কাছে উন্নত প্রযুক্তির সামরিক হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

এর আগে কখনোই বাংলাদেশের কাছে উন্নতমানের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রসীমা রক্ষা ও সীমান্ত নিরাপত্তাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর মিয়ানমারের উস্কানিমূলক আচরণের কারণে বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা অবস্থা আগের চেয়ে ভিন্ন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর অ্যালিস জে. ওয়েলস সাংবাদিকদের বলেন “বঙ্গোপসাগর উদ্যোগের আওতায় আমাদের সামরিক বাহিনীগুলোর মধ্যে আরও সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চাই।”

তিনি বলেন, দুর্যোগকালীন মানবিক সহয়তা ও সামুদ্রিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘদিনের সহযোগিতা রয়েছে।

অ্যালিস বলেন, “হোলি আর্টিজান বেকারি আক্রমণের পর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।”

তিনি বলেন, আমাদের সহযোগিতার কারণে সন্ত্রাসী ও সম্ভাব্য সন্ত্রাসী আক্রমণ ঠেকানো গেছে।

বাংলাদেশের জন্য সুযোগ

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গোপসাগর উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব কমানো।

তিনি বলেন, “সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মার্কিন প্রস্তাব আমাদের জন্য সুযোগ। এই সুযোগ আমাদের গ্রহণ করা উচিত।”

তাঁর মতে, বঙ্গোপসাগরে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত। আর ওই তিন শক্তির প্রত্যেকেই বাংলাদেশকে তাদের দলে নেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে ব্যাপকহারে বিতাড়নের পর বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে নিরাপত্তা অবস্থা বদলে গেছে।

আব্দুর রশীদ বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের পর বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারতের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সামরিক সরবরাহের জন্য মূলত চীনের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছে; চীনের সহয়তায় ডুবোজাহাজ ঘাঁটি নির্মাণ করছে।

আব্দুর রশীদ বলেন, “কিন্তু দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকটে চীন আমাদের সমর্থন করে না।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কাছে প্রথমবারের মতো উন্নত প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

তাঁর মতে, “আমাদের উচিত আমাদের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে একটি ভারসাম্যে নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব কাজে লাগানো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোনো দেশের দলে যেতে পারবে না। কারণ আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।

চীনকে নিয়ে চিন্তিত য় বাংলাদেশ

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন সামরিক প্রস্তাব সম্পর্কে কিছু জানাননি।

ওয়েলসের সাথে আলোচনার ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অ্যালিস ওয়েলস তাঁকে প্রশ্ন করেছেন বাংলাদেশ চীনকে নিয়ে চিন্তিত কি না। এবং বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে কি না।

“জবাবে আমি বলেছি আমরা চীনকে নিয়ে চিন্তিত নই। আমাদের বিনিয়োগ দরকার। চীন আমাদের এখানে বিনিয়োগ করছে। আমরা আমাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছি। আমরা এগুলো ভালোভাবে দেখার ব্যাপারে যথেষ্ট স্মার্ট,” যোগ করেন আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেন, “আমি তাদের বলেছি, তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। আর এ ব্যাপারে তিনি ইতিবাচক কথা বলেছেন।”

মন্ত্রী বলেন, ওয়েলস তাঁর সাথে বৈঠকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানোর সরকারি প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।

আব্দুল মোমেন বলেন, “আমি তাঁকে বলেছি, ওখানে তারা ভূমিধ্বসে মারা যাচ্ছে। কক্সবাজারে চাপ কমাতে আমরা তাদের সরাতে চাই। তবে আমি তাঁকে আশ্বস্ত করেছি, কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখান পাঠানো হবে না।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, অ্যালিস ওয়েলস এর সাথে বৈঠকে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা বৃদ্ধি ও তাঁদের ভাষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমি তাঁকে বলেছি, বাংলাদেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় না। আক্রান্ত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়।”

তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ পেলে প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করা হয় এবং দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেয়া হয়।

মন্ত্রী বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্ক থাকায় র‍্যাবের পাঁচ কর্মকর্তা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ কারাগারে রয়েছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাথে সন্ত্রাস বিরোধী সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে তাঁকে জানিয়েছেন অ্যালিস ওয়েলস।

বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যাবেন অ্যালিস। তিনি সেই দিনই ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।