সময়মতো প্রকল্প শেষ হয়নি, খরচ হয়েছে দ্বিগুণ

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.04.17
ঢাকা
সময়মতো প্রকল্প শেষ হয়নি, খরচ হয়েছে দ্বিগুণ বিআরটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাঝখানে বাসের জন্য বিশেষ লেন তৈরি করা হলেও নেই পথচারী পারাপারের পর্যাপ্ত নিরাপদ ও সুবিধাজনক ব্যবস্থা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করছেন পথচারীরা। ছবিটি মঙ্গলবার টঙ্গী কলেজ গেট এলাকা থেকে তোলা। ১৬ এপ্রিল ২০২৪।
[সনি রামানী/বেনারনিউজ]

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প এক যুগ পার হলেও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এরই মধ্যে তিনটি চীনা কোম্পানির মাধ্যমে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।

স্থানীয় এলাকাবাসী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে বিশেষায়িত বাসের লেন নির্মাণের ফলে যানজট কমার বদলে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন তারা। গত মার্চে প্রকল্পের একটি লেন খুলে দেওয়া হয়।

যদিও সরকারের দাবি, প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে যানজট কমবে, যোগাযোগ অনেকটাই সহজ হবে।

দেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল গাজীপুর জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ সহজতর ও যানজটমুক্ত করতে ২০১২ সালে শুধুমাত্র বাস চলাচলের জন্য ঢাকা-গাজীপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাঝখানে একটি বিশেষায়িত বাস লেন স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় সরকার।

চার বছরের পরিবর্তে এক যুগ পর গত ৫ মার্চ বিআরটি প্রকল্পের গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার উড়াল সড়কের একটি লেন খুলে দেওয়া হয়।

২০১৬ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিলেও তা পুরোপুরি শেষ হয়নি। বাস্তবায়নকাল পাঁচবার বাড়িয়ে দুই হাজার ৪০ কোটি টাকার খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

বিভিন্ন মহলের আশঙ্কা, এই প্রকল্পের কারণে ভবিষ্যতে যানজট আরও বাড়তে পারে।

গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও বর্তমান মেয়রের ছেলে মো. জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিআরটি প্রকল্প গাজীপুরবাসীর জন্য একটি বোঝা এবং এই মহাসড়ককে রক্ষা করতে হলে এটি ভেঙে ফেলার বিকল্প নেই।”

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বেনারকে বলেন, “বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কটি হারিয়ে গেছে, ফলে দেশের শিল্প ও অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়বে।”

 

‌‌গাজীপুরের জন্য ‘‌বিরাট অভিশাপ’

মো. জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “পাঁচবার সময় বাড়িয়ে চার বছরের কাজ ১২ বছর ধরে করা হয়েছে। প্রকল্পটি নেওয়া থেকে শুরু করে কখনই গাজীপুরবাসীর অথবা সিটি করপোরেশনের মতামত নেওয়া হয়নি। এই প্রকল্পের কারণে আমাদের পুরো গাজীপুরে যানজট বেড়েছে।”

তিনি বলেন, “ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন ৩৮ জেলার যানবাহন চলাচল করে। সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় এক লাখ। আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই মহাসড়ক ব্যবহার করা যানবাহনের সংখ্যা দাঁড়াবে কমপক্ষে আড়াই লাখ। বিআরটি দিয়ে প্রতিদিন মাত্র ২০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে।

“ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কটি ১০০ ফুট ছিল। এই রাস্তার মাঝখান দিয়ে আলাদা চার লেনের বিআরটি সড়ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে দুই পাশে মাত্র ২২ ফুট করে রাস্তা রয়েছে। কোনো মহাসড়ক এত কম প্রশস্ত হয় না। দুই পাশের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় যানজট লেগে থাকে,” বলেন তিনি।

জাহাঙ্গীর বলেন, “মাঝখান দিয়ে বাস চলার পথ করা হয়েছে। যাত্রীদের বাসে উঠতে দুই ধারের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে ৬৯টি সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় টার্মিনালে উঠতে হবে। বয়স্ক মানুষের পক্ষে যা অসম্ভব।”

তিনি বলেন, “এটি গাজীপুরের জন্য এক বিরাট অভিশাপ। এই সমস্যা সমাধানে উড়াল সড়কে ভেঙে ফেলতে হবে বা বিমানবন্দর কিংবা টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ছয় লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে হবে।”

 

7730a7c5-9656-4f4f-baa0-57356e3fb504.jpg
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নির্মিত বিআরটি প্রকল্পের বাস লেনে দাঁড়িয়ে অনির্ধারিত স্থানে যাত্রী উঠানামা করছে বাসগুলো। ফলে যানজট নিরসনের উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্পটির লক্ষ্য অর্জিত হবে না বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ছবিটি মঙ্গলবার টঙ্গীর কাছে আব্দুল্লাহপুর থেকে তোলা। ১৬ এপ্রিল ২০২৪। সনি রামানী/বেনারনিউজ

বিআরটি প্রকল্প সম্পর্কে

সড়ক পথে যানজটমুক্ত ও যোগাযোগ সহজ করতে ঢাকা-গাজীপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশ ছেড়ে দিয়ে মাঝখান দিয়ে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার চার লেনের একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এই বিশেষায়িত লেন দিয়ে বাস চলবে।

সিগনাল এড়াতে এই লেনটির বিভিন্ন অংশে আটটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। আর মহাসড়কের দুই পাশের বাকি অংশ দিয়ে অন্যান্য যানবাহন চলাচল করবে।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, চালু হলে গাজীপুরের শিববাড়ী মোড় থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চলাচল করবে। সময় লাগবে ৩৫ মিনিট। প্রতি ঘণ্টায় উভয় দিকে ২০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ফরাসী উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে তিনটি চীনা কোম্পানিকে এই প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে; চায়না গেজুবা গ্রুপ করপোরেশন, জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ও ওয়েইহাই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোঅপারেটিভ কোম্পানি লিমিটেড।

গত মাসে বিআরটি প্রকল্পের কয়েকটি র‌্যাম্প যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বিরাট বোঝা’

অধ্যাপক ড. শামসুল হক বেনারকে বলেন, বিআরটি প্রকল্পটি আমাদের জন্য একটি ‘বিরাট বোঝা’ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, “বিআরটি বিশ্বের ১৮০টি দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং যানজট নিরসনে একটি কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো দেখে আমাদের নীতি-নির্ধারকরা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করছেন। বিষয়টি এ রকম যে, কারও গায়ে একটি জামা দেখে ভালো লেগেছে; সেটি কিনে ফেললাম। দেখলাম না যে জামাটি আমার গায়ে লাগবে কি না।”

যাঁরা এই প্রকল্পটির ডিজাইন করেছেন, তাঁরা গণপরিবহন ব্যবস্থার চরিত্র না বুঝে কেবলমাত্র রাস্তা ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছেন বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, “এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল গাজীপুর শিল্প এলাকার বড় বড় ট্রাক-লরি নির্বিঘ্নে চলাচল করবে এবং একইসঙ্গে সেখানকার শিল্প কারখানার শ্রমিকরা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবেন। কিন্তু শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই। নির্বিঘ্নে যানবাহনও চলাচল করতে পারবে না।”

শামসুল হক আরও বলেন, “এই ধরনের প্রকল্প সাধারণত শহরের কেন্দ্রে করা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বাস্তবায়নের জন্য। সেটি না করে প্রকল্পটি ঢাকার বাইরে গাজীপুরে বাস্তবায়ন করা হয়েছে; যেখানে দেশের অন্যতম ব্যস্ততম শিল্প এলাকা। এই ঢাকা-গাজীপুর রাস্তাটি বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ জেলায় যাওয়ার একমাত্র মহাসড়ক।

“এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আমরা ঢাকা-গাজীপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কটি হারালাম। এই মহাসড়কের কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত নেই। এই প্রকল্পটি আমাদের শিল্প বিকাশের পথে মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াবে। একইসঙ্গে এই প্রকল্পের বিপরীতে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

এই প্রকৌশলী বলেন, “প্রকল্পটি যে সঠিকভাবে কাজ করবে না, সেটি আগে থেকেই বোঝা গিয়েছিল। চীনা কোম্পানিগুলো প্রকল্পের যে মূল খরচ, তার চেয়ে শতকরা ২৭ শতাংশ কম রেট দিয়ে কাজ নিয়েছে এবং পরে তারা কালক্ষেপণ করে প্রকল্পের মূল্য দ্বিগুণ করেছে।”

চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ঢাকায় চীনা দূতাবাসে ইমেইল পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা পর্যন্ত জবাব পাওয়া যায়নি।

এর আগে ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গাজীপুরে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প গলার কাঁটা হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন।

 

আশাবাদী সরকার

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট অনুবিভাগ) নীলিমা আখতার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিআরটি প্রকল্পে কিছু কিছু স্থানে বটলনেক (সংকীর্ণ জায়গা) রয়েছে। ফুটপাতের জায়গা বেশি নেই। যানজট হচ্ছে। এই মহাসড়ক দিয়ে ২১টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। এগুলো নিয়ে অংশীজনরা অনেক কথা বলেছেন। কথাগুলো সব ভুল নয়।

“আমরা এগুলো আমলে নিয়ে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। গত মাসে কয়েকটি র‌্যাম্প খুলে দেওয়ার কারণে যানজট কমে এসেছে। এই প্রকল্পটি যাতে মানুষের কাঙ্ক্ষিত সুফল আনতে পারে, সেজন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রী, সচিব  থেকে শুরু করে আমরা সবাই কাজ তদারকি করে যাচ্ছি,” বলেন তিনি।

কবে নাগাদ এই প্রকল্পের আওতায় বাস চালু হবে জানতে চাইলে নীলিমা বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আশা করা যায়, কয়েক মাসের মধ্যেই ঢাকা-গাজীপুর রুটে আর্টিকুলেটেড বাস সেবা চালু হবে।”

 

সরেজমিন চিত্র

বেনার প্রতিনিধি মঙ্গলবার বিআরটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছে। দেখা গেছে, যাত্রীদের বাসে ওঠা-নামার জন্য ওভারপাসের ওপর লেনের মাঝখানে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

নিচতলা থেকে উপরের টার্মিনালে ওঠার জন্য খাড়া সিঁড়ি রাখা হয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য। কিছু টার্মিনালে লিফটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফুটপাত থেকে পাশের রাস্তা পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের রাস্তা পার হতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বোর্ড বাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হাকিম বেনারকে বলেন, “বিআরটি হওয়ার পর মানুষের রাস্তা পারাপারে ঝুঁকি মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, রাস্তা পার হতে গিয়ে মানুষ দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে।”

তিনি বলেন, “অন্যদিকে রাস্তার দুই পাশে যানজট বেড়েছে। ১২ বছর ধরে গাজীপুরের মানুষ এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে। টার্মিনালে গাড়ি চলাচলের পথ খুবই সংকীর্ণ হওয়ায় বাস পার হতে সময় লাগবে এবং যানজট বাড়বে বলে সবাই মনে করছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।