কম্বোডিয়ায় বাড়ছে বানর রপ্তানির অবৈধ ব্যবসা

জ্যাক অ্যাডামোভিচ ডেভিস, আরএফএ
2023.04.07
কম্বোডিয়ায় বাড়ছে বানর রপ্তানির অবৈধ ব্যবসা
ইলাস্ট্রেশন: আমানডা ওয়েইসব্রড/আরএফএ। ছবি: রয়টার্স।

অবৈধ পন্থায় বানর রপ্তানি ব্যবসা ক্রমেই বেড়ে চলেছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায়। অধিক লাভের আশায় এতে সম্পৃক্ত হয়েছেন ক্ষমতাবানরা, ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রশ্নে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

দেশটির কামপং স্পেউ প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে রয়েছে একটি বানরের খামার। এর যৌথ মালিকানায় আছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের বোন হান সেংনি।

খামারটির নিরাপত্তায় চারপাশে নির্মিত রয়েছে খালের মতো পরিখা। খালের পরে মাটি থেকে দুই মিটার উচ্চতার ইটের দেয়াল, তার ওপরে কাঁটাতারের বেড়া। ভেতরে সব সময় নিরাপত্তাকর্মীরা কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে টহল দিচ্ছেন।

কেন এত নিরাপত্তা সেই কথা বেনার নিউজের সহপ্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছেন ওই খামারের একজন প্রাক্তন কর্মচারী।

monkey2.jpeg
কামপং স্পেউ প্রদেশে গ্রামাঞ্চলে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের বোন হান সেংনির যৌথ মালিকানাধীন খামারে বানরের খাঁচা। মার্চ ২০২৩। [আরএফএ]

কেন এত নিরাপত্তা?

খামারে বন্দি রয়েছে লম্বা লেজের ম্যাকাক প্রজাতির বানর। চিকিৎসা গবেষণায় এই প্রজাতির বানর বেশি ব্যবহৃত হয়। ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগ ইয়েলো ফিভারের টিকা আবিষ্কারে এই প্রজাতির বানরের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, ১৮ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েলো ফিভার মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সম্প্রতি প্রজনন, স্থূলতা, এমনকি আসক্তির চিকিৎসায় ম্যাকাক প্রজাতির বানরের ওপর গবেষণা চালানো হচ্ছে।

করোনা মহামারি শুরুর পরে গবেষণার জন্য এই প্রজাতির বানরের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই সময় কম্বোডিয়া এই ব্যবসায় পা রাখে। এক পর্যায়ে লম্বা লেজের ম্যাকাক প্রজাতির বানর রপ্তানির মূল কেন্দ্রে পরিণত হয় কম্বোডিয়া। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় এতে সম্পৃক্ত হয় দেশটির অভিজাত রাজনৈতিক শ্রেণির লোকজন।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, হান সেংনির মালিকানাধীন প্রাইমেট ফার্মগুলোর মতো প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ম্যাকাক প্রজাতির বানর রপ্তানি করে।

কম্বোডিয়া সারা বিশ্বে বানর রপ্তানি শুরুর পরে এর উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এখানেই শেষ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি উচ্চ পর্যায়ের মামলাও দায়ের হয়। তাতে অভিযোগ আনা হয়, কম্বোডিয়ার সরকারি কর্মকর্তারা অবৈধ পন্থায় বানর রপ্তানি বাণিজ্যে সম্পৃক্ত।

ওই মামলায় কম্বোডিয়ার দুই জন জ্যেষ্ঠ বন্যপ্রাণী কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।

তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মার্কিন আমদানি নিষেধাজ্ঞা এবং বিপন্নপ্রায় প্রজাতির প্রাণী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো এড়াতে তারা মিথ্যা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে লম্বা লেজের ম্যাকাক প্রজাতির বানর রপ্তানিতে সহায়তা করেছেন।

ঘোষণাপত্রে বিপন্নপ্রায় বানরকে ‘শিকার করা’ বানর উল্লেখ করা হয়।

গত বছরের নভেম্বরে কম্বোডিয়ার বন্যপ্রাণী ও বৈচিত্র্য পরিচালক ক্রাই মাসফাল পানামায় একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্মেলনে যাওয়ার সময় নিউইয়র্কে গ্রেপ্তার হন। ওয়াশিংটনের কাছে তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। আগামী জুনে মিয়ামির একটি আদালতে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি কর হবে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা—কম্বোডিয়ার বন প্রশাসনের পরিচালক ও ক্রাইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তখন থেকেই পলাতক।

গত ২০ বছর যাবত বিশ্বজুড়ে বন্যপ্রাণী সংশ্লিষ্ট অপরাধ তদন্ত করছেন এড নিউকামার। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। এড বলেন, “এই ধরনের ঘটনা আমাদের ভীষণ আতঙ্কের উপলব্ধির মতো।”

তিনি বলেন, “সরকারি কর্মকর্তা ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা যখন বন্যপ্রাণী ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তখন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কীভাবে আইন প্রয়োগ করবে?”

তবে অবৈধ বানর রপ্তানি ব্যবসার কথা অস্বীকার করেছে কম্বোডিয়ান সরকার। যদিও দেশটির বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রাইমেট ফার্মগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছে।

monkey4.jpeg
কম্বোডিয়ার কামপং স্পেউ প্রদেশে গ্রামাঞ্চলে বানরের খামারের মালিক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের বোন হান সেংনি। [ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত]

বানরের ব্যবসায় কম্বোডিয়ার উত্থান

কয়েক বছর আগেও ম্যাকাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে চীন বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করে ছিল। নিজস্ব ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য বেইজিং ম্যাকাক রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বিপাকে পড়ে অন্যান্য দেশ। সেই বাজার নিজের আওতায় নেয় কম্বোডিয়া।

জাতিসংঘের বাণিজ্য তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে কম্বোডিয়া মাত্র এক বছরে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৯৩১টি বানর রপ্তানির রেকর্ড করে। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৩৩ মিলিয়ন ডলার (৩৪৯ কোটি টাকা)। প্রতিটি বানরের গড় বিক্রি মূল্য ছিল দুই হাজার ২৭১ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা।

সূত্র বলছে, রপ্তানিতে বানরের সংখ্যা তখন থেকেই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বানরের দাম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গবেষণা কাজে যত সংখ্যক বন্যপ্রাণী ব্যবহার করা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করলে অত সংখ্যক প্রাণী উৎপাদন ও সরবরাহ করা কম্বোডিয়ার পক্ষে অসম্ভব।

চলতি মাসের শুরুর দিকে ‘ওয়ান হেলথ’ নামে ভেটেরিনারি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, করোনা মহামারি চলাকালে কম্বোডিয়া যে সংখ্যক ম্যাকাক রপ্তানি করেছে, বৈধভাবে সেই সংখ্যক উৎপাদন করতে হলে সক্ষমতার চারগুণ বেশি প্রজনন আবশ্যক।

গবেষকরা আরও উল্লেখ করেছেন, “ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, দ্বিতীয় প্রজন্মের ম্যাকাক উৎপাদনের সক্ষমতা কম্বোডিয়ার নেই। ফলে বৈধভাবে তারা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে বিষয়টি অসম্ভব।”

বানরের ব্যবসায় বেশি আয় ও পরস্পরের যোগসাজশ

হান সেংনির মালিকানাধীন ‘সুরক্ষিত’ খামারটি মার্কিন সরকারের মামলার অংশ নয়।

তবে নিউকামারের ভাষ্য, এটি কম্বোডিয়ার প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ক্রমবর্ধমান বানর ব্যবসার পারস্পরিক সম্পর্কের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

যে কারণে দেশটিতে এই শিল্পে সংস্কারের কোনো সম্ভাবনা নেই, মনে করেন তিনি।

হান সেংনি কম্বোডিয়ার সরকারি কোনো পদে না থাকলেও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান অনেকের সঙ্গে তার সখ্যতা রয়েছে। যে কারণে তিনি নির্বিঘ্নে তাঁর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানাতে আরএফএ’র পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও হান সেংনি সাড়া দেননি।

হুন সেনের আরেক সহযোগী কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব সেন সোভান একটি বানরের খামারের জন্য একটি জমি লিজ দিয়েছেন। মার্কিন সরকার পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্ত করছে। এছাড়া এক সাবেক মন্ত্রী গত বছর আরেকটি খামারের বাণিজ্যিক বিকাশে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ক্রাইয়ের মামলায় ওই খামারটি তালিকাভুক্ত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মার্কিন আদালতে যে রায় আসুক না কেন, প্রভাবশালী রাজনীতিকরা জড়িত থাকায় কম্বোডিয়ার বানর বাণিজ্যে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।

প্রাণীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন পিপল ফর দ্য ইথিকাল ট্রিটমেন্ট অব এনিম্যালস-এর উপদেষ্টা প্রাইমটোলজিস্ট লিসা জোনস-অ্যাঞ্জেল বলেন, “এই ব্যবসায় এখন অনেক আয়, আর অর্থ উপার্জনের সুযোগ ম্যাকাক রপ্তানি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।