ধর্ম ও রাজনীতি মেলাতে গেলে উভয়ই কলুষিত হয়: সাক্ষাৎকারে প্যাট্রিক ডি রোজারিও
2017.02.20
বাংলাদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী ধর্ম আর রাজনীতিকে আলাদা রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ইতিহাসের প্রথম বাঙালি কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও।
বেনার নিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় তার উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতায় হাজারো রোহিঙ্গার বাংলাদেশে শরণার্থী হবার প্রসঙ্গেও কথা বলেন। তার মতে “রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ হওয়া উচিত।”
গত নভেম্বরে ৭৩ বছর বয়স্ক প্যাট্রিক ডি রোজারিওকে ভ্যাটিকানে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্ডিনাল হিসেবে অভিষিক্ত করেন পোপ ফ্রান্সিস। কার্ডিনাল পদটি ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদ।
ঢাকার আর্চ বিশপ হাউসে বেনারের সাথে আলাপচারিতায় তিনি বছরের শেষ দিকে পোপের সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফরের বিষয়টিও তুলে ধরেন। পাশাপাশি পোপের সিন্ধান্তে চলতি মাসে চট্টগ্রাম ডায়োসিসের আর্চডায়োসিসে উন্নীত হবার প্রসঙ্গেও কথা বলেন।
বাংলাদেশে মোট আটটি ডায়োসিসের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আর্চডায়োসিস। বাকি ডায়োসিসগুলো হলো খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, দিনাজপুর ও সিলেট।
প্যাট্রিক ডি রোজারিও কার্ডিনাল হিসেবে মনোনয়ন পাবার পর গত অক্টোবরে বেনার নিউজ তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। আর এই সাক্ষাৎকারটি কার্ডিনাল হিসেবে বেনারের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎকার:
বেনার: প্রথম বাঙালি কার্ডিনাল হিসেবে ভ্যাটিকানে আপনার সংযুক্তি সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: এটা পোপ মহোদয়ের নিজস্ব মনোনয়ন। তিনি চেয়েছেন, ১২০ জনের কনক্লেভ যেন বিশ্বজনীন হয়, শুধু ইউরোপে সীমিত না থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। পোপ হয়তো চেয়েছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা চার্চের মধ্যে আসুক।
বেনার নিউজ: পোপ ফ্রান্সিস সম্প্রতি চট্টগ্রাম ডায়োসিসকে মেট্রোপলিটন আর্চডায়োসিস করেছেন। এর কারণ কী?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা চট্টগ্রামকে আর্চডায়োসিস স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলাম, পোপ তা অনুমোদন করেছেন। ঐতিহাসিক কারণে খ্রিস্টধর্মের গোড়াপত্তন চট্টগ্রামে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল ফোকাস। চট্টগ্রামের অধীনে ছিল মিয়ানমার ও ইন্ডিয়া। মেট্রোপলিটন ডায়োসিস হওয়ায় মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীরতা লাভ করবে।
বেনার নিউজ: বাংলাদেশে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের উত্থান সম্পর্কে কিছু বলবেন?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: বর্তমান সন্ত্রাসবাদ এখানকার কৃষ্টিগত ও সংস্কৃতিগত নয়। বাইরে থেকে এসেছে। আমরা এখানে একসঙ্গে জীবন যাপন করছি। ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, ধর্মকে নিয়েই আছি। প্রতিবছর রামকৃষ্ণ মিশনে বড় দিনে ধর্মীয় সংলাপ হয়। এটা কোনো দেশে পাবেন না। কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি ছোট একটি সমাজকে বড় দিনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা দেবে না। সহনশীল কৃষ্টির বহমান ঐতিহ্য আছে। এখানে ছোট খ্রিস্টান সমাজ বৃহত্তর মুসলিম সমাজের সঙ্গে ভালো আছে। কিন্তু কিছু মানুষ ভুল পথে গিয়ে ভিন্ন ধর্ম ও মতাবলম্বীদের টার্গেট করছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের হত্যা করছে। এটা দুঃখজনক, নিন্দনীয় কাজ।
বেনার নিউজ: সহনশীল ঐতিহ্যের কথা বলছেন। কিন্তু ধর্মের কারণে অনেক দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগের ঘটনাও এখানে আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: পাকিস্তান ধর্মের কারণে বিভক্ত হয়েছে। ধর্মের নামে দাঙ্গা হাঙ্গামা অনেক হয়েছে, এটা ঐতিহাসিক সত্য। দাঙ্গা হয়েছে পলিটিক্যাল কারণে। আজ আমরা একটা শিক্ষা পাচ্ছি। পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পরও কেন স্বাধীন হতে হলো? পাকিস্তানিরা কৃষ্টিতে আমাদের সঙ্গে এক ছিল না। তাই বলব, শুধু ধর্ম মানুষকে এক করে না। পাকিস্তান যখন সৃষ্টি হলো তখন ওহাবি আন্দোলনের প্রভাব ছিল। তারা মডেল ইসলামিক কান্ট্রি চেয়েছে। সেটা হয়নি। ধর্মকে রাজনীতির মধ্যে ঢোকানো ঠিক নয়। যখনই হয়েছে তখনই সমস্যা তৈরি হয়েছে। খ্রিস্টানরা ক্রুসেড করেছে না? চার্চকে আমরা এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে মিলাতে দেইনি। চার্চ এবং স্টেট ভিন্ন। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকুক, ধর্ম ধর্মের জায়গায়। ধর্ম ও রাজনীতিকে মেলালে উভয়ই কলুষিত হয়।
বেনার নিউজ: ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্রতার বিশ্বজনীন রূপ দেখা যাচ্ছে। একজন ধর্মগুরু হিসেবে আপনি একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে সেক্যুলারাইজেশনের ধারণা এসেছে, যার মূল কথা যুক্তিবাদ। যুক্তিতে ঈশ্বর নেই, সুতরাং বাদ। তারা ধর্মকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন ধর্মচ্যুত যুক্তিবাদ এবং যুক্তিবাদ বিচ্যুত মৌলবাদ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। ধর্মচ্যুত যুক্তিবাদ হচ্ছে সেক্যুলারিজম। এর বিপরীতে আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন অসাম্প্রদায়িকতার কথা। এটা ভালো। ধর্মীয় পরিচয় কোনোভাবেই ঢাকবে না।
বেনার নিউজ: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে কিছু বলবেন?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ হওয়া উচিত। তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার দিতে হবে। কোনো জাতিগোষ্ঠীর ওপর অন্যায় গ্রহণযোগ্য নয়। শতবর্ষ থেকে মিয়ানমারে তাদের বসতি। তাদের হটিয়ে দেওয়া, তাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। এটা একটা মানবিক ব্যাপার।
বেনার নিউজ: বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: ছোট হলেও এ দেশে খ্রিস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা বেশ কাজ করছি। সমাজ উন্নয়নে কারিতাস এবং সিসিডিপি কাজ করছে। কারিতাসের ৭৫ শতাংশ কর্মী অন্য ধর্মের। আমাদের স্কুলগুলোতে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ভিন্ন সম্প্রদায়ের। নটর ডেম কলেজে ৮৪ শতাংশ গ্রাম থেকে এসেছে। পিছিয়ে পড়া লোকদের সেবা করার যে সাংবিধানিক নির্দেশনা আছে সেটাকে অনুসরণ করছি। আন্তধর্ম সংলাপ আমরাই শুরু করেছিলাম। এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে চালানো হচ্ছে। আমরা বলতে চাচ্ছি, চার্চ খুব ছোট হলেও বড় অবদান রেখে যাচ্ছে। শুধু খ্রিস্টানদের জন্য নয়, সবার জন্য করছি। আমাদের এই সেবাদান থেকে যেন বঞ্চিত না করা হয়।
বেনার নিউজ: বঞ্চিত করার কথা কেন বলছেন?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: নতুন নতুন নিয়ম আসছে যেগুলো হাত-পা বেঁধে দিচ্ছে। মিশন স্কুলগুলো পরিচালনার জন্য ফাদার মাদার আছে। স্বাভাবিকভাবে আমরা তাদের হাতে দেবো। সেই নিয়োগ দেওয়ার অধিকার থাকছে না। নটর ডেম, হলি ক্রস, সেন্ট গ্রেগরি সবগুলোর ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। ২০১২ সালে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। পাঁচ বছর কেটে গেলো। সার্কুলার পেলাম না।
তারা বলছেন অনলাইনে ভর্তি হবে শুধু নম্বরের ভিত্তিতে। কোথা থেকে, কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে তা দেখবে না। মানুষগুলো কি শুধু নম্বর হয়ে গেছে? নম্বর দিয়ে যাচাই বাছাই করতে হবে?
সরকার বলছে, আমরা ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ করতে চাই। আমাদের এখানে ভর্তি বাণিজ্য হলে আমাদের বলেন। অন্যরা করে, আমাদের কেন বলছেন?
বেনার নিউজ: পোপ ফ্রান্সিস এ বছর বাংলাদেশে আসার কথা। এ বিষয়ে প্রস্তুতি কী? কবে নাগাদ আসতে পারেন?
প্যাট্রিক ডি রোজারিও: এখনো অফিসিয়াল তারিখ নির্ধারণ হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব আসবে মার্চে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওনাকে আমন্ত্রণ করেছেন। ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে প্রোগ্রাম নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বাংলাদেশে এক থেকে দেড় দিন থাকবেন।
তার কর্মসূচিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক থাকবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন। খ্রিস্টান জনগণের জন্য ধর্মীয় উপাসনা এবং একটি আন্তধর্মীয় সমাবেশ করার ইচ্ছে আছে।