বাল্য বিবাহ রোধে নিবন্ধকদের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.05.29
ঢাকা
বাঙালি বিয়ের সাজে অপরিহার্য উপাদান মেহেদি। বাঙালি বিয়ের সাজে অপরিহার্য উপাদান মেহেদি। ফাইল ফটো, অক্টোবর, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

নতুন আইনের ‘বিশেষ বিধান’ এর সুযোগে দেশে বাল্য বিবাহ বেড়ে যাবে, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এমন আশঙ্কা উপেক্ষা করে গত ফেব্রুয়ারিতে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ পাস করলেও বাল্য বিবাহ রোধে বিবাহ নিবন্ধকদের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে সরকার।

“বাল্য বিবাহ বন্ধ করার জন্য বিবাহ নিবন্ধকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ওপর নজরদার বাড়িয়েছে সরকার,” বেনারকে বলেন আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাজমুস শাদাত।

প্রসঙ্গত, এর আগের আইনটি ছিল ১৯২৯ সালের। ২০১৭ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ ১৮ বছরের নিচে কন্যা শিশুদের বিয়ের বিধান রাখা হয়। গত মাসে আইনের এই বিশেষ বিধানটি চ্যালেঞ্জ করে দুটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে একটি রিট করে।

নতুন আইনের ১১ ধারায় বাল্য বিবাহ নিবন্ধন করলে নিবন্ধকের জন্য জরিমানাসহ ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মহিলা অধিদপ্তরের মাল্টি সেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক ড. আবুল হোসেন বেনারকে বলেন, “১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনে বিবাহ নিবন্ধকদের জন্য শাস্তির বিধান ছিল না। বাল্য বিবাহ নিবন্ধনের দায়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অনেক নিবন্ধকের লাইসেন্স বাতিল করা হতো, শাস্তি দেওয়া হতো।”

“২০১৭ সালের আইনে ওই সকল নির্বাহী আদেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে,” জানান তিনি।

গত দুই বছরে বাল্য বিবাহ নিবন্ধন করার অপরাধে ২০ জন নিবন্ধকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

“বাল্য বিবাহ নিবন্ধনের অপরাধে ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ জন বিবাহ নিবন্ধকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন এই সকল বিবাহ নিবন্ধকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেবে,” বেনারকে জানান নাজমুস শাদাত।

সারা দেশে আইন মন্ত্র‍ণালয় অনুমোদিত ৭,৯০১ জন বিবাহ নিবন্ধক রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, দেশের বিদ্যমান আইনে সাধারণ পরিস্থিতিতে ১৮ বছরের নিচে নারী ও ২১ বছরের কম বয়সী ছেলের বিবাহ নিবন্ধন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার শতকরা ৫২ ভাগ।

এদিকে নিবন্ধকদের ওপর সরকারের নজরদারিকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

“তাঁদের (নিবন্ধকদের) কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাল্য বিবাহ কমে আসবে। কারণ, তারা বিয়ে নিবন্ধন না করলে তো আর বিয়ে নিবন্ধন হয় না,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান সালমা আলী।

তবে পরিবারের চাপে অনেক সময় অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে নিবন্ধন করতে বাধ্য হতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন নিবন্ধকরা।

“বাবা-মা সহ সবাই আমাদের কাছে আসেন ছোট মেয়ের বিয়ে নিবন্ধন করার জন্য। আমরা করতে না চাইলেও তারা চাপাচাপি করেন। অনেক সময় আমাদের বিয়ে নিবন্ধন করতে বাধ্য করা হয়।” বেনারকে বলেন বগুড়া জেলার মাঝিরা ইউনিয়নের বিবাহ নিবন্ধক আবু বকর সিদ্দিক।

এমন প্রেক্ষাপটে নিবন্ধকদের শাস্তির পাশাপাশি বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করার পক্ষে মত দেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মমিন।

তিনি বেনারকে বলেন, “অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, যাতে তারা বাল্য বিবাহ না দেন। কারণ, অভিভাবকরাই বাল্য বিবাহ নিবন্ধনের জন্য যান।”

উদাহরণ বগুড়া

বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এই এলাকার চারজন বিবাহ নিবন্ধকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে এবং বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “গত বছর ডিসেম্বর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শাহজাহানপুর উপজেলায় মোট ৪২টি বাল্য বিবাহ সংক্রান্ত মামলা রুজু করা হয়েছে।”

এসব তৎপরতার কারণে গত দুই-এক বছর ধরে এই অঞ্চলে বাল্য বিবাহ অনেক কমে এসেছে বলে জানান সিরাজুল ইসলাম।

“কাজীদের (নিবন্ধকদের) জেল দেওয়ার ফলে এখন তারা খুব সতর্ক থাকেন; বাল্য বিবাহ নিবন্ধন করেন না। বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনটি প্রয়োগ করা গেলে দেশ বাল্য বিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে।” বলেন তিনি।

কুড়িগ্রাম উদ্যোগ: মোবাইল অ্যাপে বয়স যাচাই

ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন দেশে প্রথমবারের মতো একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে। এর মাধ্যমে বিবাহ নিবন্ধনের আগে বর-কনের নাম লিখে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ১৬১০০ নম্বরে এসএমএস পাঠালে জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার থেকে তাদের জন্ম তারিখসহ একটি এসএমএস আসবে।

যদি মেয়ের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং ছেলের বয়স ২১ বছর না হয় তাহলে বিয়ে নিবন্ধন হবে না।

এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বেনারকে বলেন, “২০১৪ সাল থেকে পাইলট প্রকল্পের পর গত মাসে জেলার তিনটি উপজেলায় মোবাইল এসএমএস এর মাধ্যমে বর-কনের বয়স যাচাই করে বিবাহ নিবন্ধন শুরু হয়েছে।”

“এখন পর্যন্ত এটা ভালোই কাজ করছে এর মাধ্যমে অনেক বাল্য বিবাহ নিবন্ধন বন্ধ করা গেছে,” বলেন তিনি।

নতুন আইনের ‘বিশেষ বিধান’ চ্যালেঞ্জ

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ের বিধানের সুযোগ নিয়ে দেশে বাল্য বিবাহ বাড়বে। এতে করে বেড়ে যাবে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হারও। পাশাপাশি নারী নির্যাতনের পরিমাণ ভয়াবহ আকার নেওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা।

আইনের এই ধারাটি চ্যালেঞ্জ করে গত ৫ এপ্রিল আদালতে রিট করেছে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ও নারীপক্ষ। রিট আবেদনটি এখন শুনানির অপেক্ষায়।

আবেদনে সংগঠন দুটি বলেছে যে, আইনের ১৯ দফার বিশেষ বিধান অন্যান্য ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এ প্রসঙ্গে গত ৭ এপ্রিল সংগঠন দুটির পক্ষে রিট আবেদনকারী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বেনারকে বলেন, “বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ১৯ দফা বাংলাদেশ সিডও সহ যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং দেশে যেসব আইন আছে তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য জানতে চাইছি। এতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়কে দায়বদ্ধ করা হয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।