বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যাবে কন্যাশ্রী
2017.07.28
কলকাতা
গ্রামের দরিদ্র স্কুল ছাত্রীরা যাতে পড়াশোনা ছেড়ে বাল্য বিবাহের শিকার না হয় সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত কন্যাশ্রী প্রকল্পে আগামী দিনে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদেরও অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রতি কন্যাশ্রী প্রকল্পের জাতিসংঘ পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে রাজ্যজুড়ে আয়োজিতে উৎসবের কলকাতার মূল অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন।
গত ২৩ জুন নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগ-এ বিশ্বের ৬২ দেশের ৫৫২টি সামাজিক প্রকল্পের মধ্যে জন-পরিষেবায় অভিনবত্বের জন্য শ্রেষ্ঠ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কন্যাশ্রী প্রকল্পকে জাতিসংঘ জন পরিষেবা পুরস্কার দেওয়া হয়।
“এই প্রকল্পের ফলে গ্রামে গ্রামে মেয়েরা গরিবির প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে নিজেদের প্রতিভাকে মেলে ধরতে পারছেন। স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যেতে পারছেন,” বেনারকে বলেন সমাজবিজ্ঞানী মধুমিতা রায়।
তিনি বলেন, “পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বাল্যবিবাহ রুখে দিয়ে কন্যাশ্রী মেয়েরা সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। মেয়েদের এই যুদ্ধজয়ে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প।”
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের সচিব রোশনি সেন সাংবাদিকদের বলেন, নাবালিকা বিবাহ রোধে মেয়েদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে এই কন্যাশ্রী প্রকল্প। কম সুবিধাভোগী মেয়েদের আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে শিক্ষা প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার ফলে রাজ্যে মেয়েদের সাক্ষরতার হারও অনেক বেড়েছে।
শুক্রবারের অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের প্রতিনিধি ইয়াসমিন আলী হকও এই প্রকল্পের সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
কন্যাশ্রী প্রকল্প কী
গ্রামের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মেয়েরা যাতে পড়াশোনা ছেড়ে না দেয় এবং বাল্য বিবাহ না করে সে জন্য ২০১৩ সালে এই অভিনব কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।
রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের এক আধিকারিক বেনারকে বলেন, এই প্রকল্পের অধীনে ১৩ থেকে ১৮ বছরের অবিবাহিত মেয়েদের ৭৫০ রুপি করে বার্ষিক আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১৮ বছর পূর্ণ করা অবিবাহিত মেয়েদের স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে দেওয়া হয় এককালীন ২৫ হাজার রুপির অনুদান।
এই মুহূর্তে রাজ্যে ৪১ লক্ষ ২৪ হাজার ৯৮৩ জন মেয়ে এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে বলেও তিনি জানান।
জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশের মধ্যে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সমীক্ষার তথ্য মতে, পশ্চিমবঙ্গে বাল্য বিবাহের হার ৫৪.৭ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী বিবেক মহাপাত্র বেনারকে বলেন, “কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে দরিদ্র পরিবারে। সংসারের অভাব অনটন থাকায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চান পরিবারের লোকেরা।”
“কন্যাশ্রী প্রকল্প মেয়েদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করেছে। মেয়েরা নিজেরাই অগ্রণী হয়ে বাল্য বিবাহ রুখে দিচ্ছে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার শপথও নিচ্ছে,” বেনারকে বলেন বর্ধমানের স্কুল শিক্ষিকা সুলতা রায়।
সাফল্যের নজির
মুর্শিদাবাদের হরিহর পাড়ার ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার পূর্ণেন্দু সান্যাল বেনারকে বলেন, রাজ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হওয়ার পরে বিভিন্ন জেলার ব্লকে ব্লকে প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া মেয়েদের নিয়ে জেলা প্রশাসন তৈরি করেছে এক একটি দল।
তিনি বলেন, “কন্যাশ্রী যোদ্ধারা এখন আমাদের গর্ব। বাল্য বিবাহ রুখতে এই যোদ্ধারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে। অল্প বয়সে বিয়ে না দিয়ে যাতে ওরা পড়াশোনা করতে পারে প্রশাসনের তরফ থেকে সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।”
“কোনো নাবালিকার বিয়ের খবর পেলেই পুলিশ ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সেই বাড়িতে যাই আমরা। পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করি। সোজা কথায় কাজ না হলে নাবালিকা বিয়ে দেওয়ার দায়ে জেল খাটতে হবে বলেও জানানো হয়। অনেক সময়ই পিতা মাতা ভুল বুঝতে পেরে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুচলেকাও দেন,” বেনারকে বলেন কন্যাশ্রী যোদ্ধা আশাপূর্ণা।
এই যুদ্ধে অংশ নিতে পেরে কন্যাশ্রী যোদ্ধা আশালতা বিশ্বাস, নাফিসা খাতুনরা খুবই গর্বিত। এরা কেউ একাদশ শ্রেণির ছাত্রী, কেউবা মাধ্যমিক পাশ করেছে। এদেরও মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। এখন তারাই অন্যদের বিয়েও রুখে দিচ্ছে।
মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে জেলার ২৬টি ব্লকের মধ্যে ৮টি ব্লকে কন্যাশ্রীরা ১৫০টির বেশি বাল্যবিবাহ রুখে দিয়েছে। অন্যান্য জেলাতেও এই চিত্রটা কমবেশি একই।
এদিকে কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের জন্য এনজিওর সহযোগিতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে জেলা প্রশাসন। হুমকির মুখে মাথা ঠান্ডা রেখে কী করা উচিত তাও যেমন শেখানো হচ্ছে তেমনি যে কোনো অন্যায়ের খবর পেলে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
বাল্যবিবাহের পাশাপাশি নারী পাচার, লিঙ্গবৈষম্য ও ইভটিজিং বন্ধ করার কাজেও কন্যাশ্রী যোদ্ধাদের কাজে লাগানোর ভাবনা রয়েছে সরকারের।
কন্যাশ্রীর এককালীন অনুদানে অনেক মেয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছেন। বর্ধমানের হাট গোবিন্দপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী পারসিনা খাতুন কন্যাশ্রী প্রকল্পের ২৫ হাজার রুপিতে বিউটি পার্লার খুলেছেন।
এই রোজগারেই গত তিন মাস ধরে নিজে পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন বলে পারসিনা জানান। তাঁর বাবা-মা পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে না বলে জানিয়েছিল।
একইভাবে ক্ষেতমজুরের কন্যা আল্পনা অনুদানের অর্থে পুতুল তৈরি এবং পুতুল নাচ দেখানো শিখে এখন গ্রামে গ্রামে পাপেট শো করে অর্থ উপার্জন করেন। এই দিয়েই পড়ার খরচ চালানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী আল্পনা।