নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এন্টিবায়োটিক-রোধি ব্যাকটেরিয়ায়

পুলক ঘটক
2021.07.16
ঢাকা
নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এন্টিবায়োটিক-রোধি ব্যাকটেরিয়ায় কক্সবাজারের উখিয়ায় একটি রোহিঙ্গা শিবিরের সামনে সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মা। জুলাই ২২, ২০২০
সাবরিনা ইয়াসমীন

গবেষকেরা বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে একটি বিশেষ ধরণের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন, যেটি এন্টিবায়োটিক দিয়ে সারানো যাচ্ছে না। এর ফলে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে।

এ ধরনের নিউমোনিয়ায় ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের ব্যবধানে ঢাকায় শুধু একটি হাসপাতালে প্রায় ২০০ শিশু মারা গেছে, যাতে বোঝা যায় অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার প্রাণঘাতি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল (এমজিএইচ) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি) শাখার যৌথ গবেষনায় প্রাপ্ত এই তথ্য বৃহস্পতিবার রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়।

ওপেন ফোরাম ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, “এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এন্টিবায়োটিক-রোধী এই ব্যাকটেরিয়া বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মারাত্মক মহামারির সৃষ্টি করতে পারে। ”

ঢাকায় আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪০০৭ টি শিশুর ওপর পরিচালিত এই গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, “যেসব শিশুর ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়া ছিল না, তাদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাকটেরিয়া জনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৭ গুণ বেশি ছিল, যা উদ্বেগের বিষয়।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে আইসিডিডিআর,বি’র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “ভাইরাসের কারণে শিশুদের নিউমোনিয়া হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণেও নিউমোনিয়া হতে দেখা যায়। কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া।”

আইসিডিডিআর,বির পুষ্টি ও ক্লিনিক্যাল সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।

তাকে উদ্ধৃত করে সংবাদ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমাদের হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক ও শ্বাসতন্ত্রের উন্নততর চিকিৎসা পাওয়ার পরেও ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।”

“আক্রান্ত অনেক শিশুর শরীরে এন্টিবায়োটিক কাজ করছিল না। এটা দেখার পরই গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি,” বলেছেন ড. চিশতি।

নিউমোনিয়া ফুসফুসের একটি সংক্রমণ, যার ফলে বায়ু থলিতে তরল পদার্থ ও পুঁজ জমা হয়। এতে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। কার্যকর চিকিৎসা ছাড়া এই সংক্রমণ মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

নতুন এই গবেষণায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কমবয়সী ৪০০৭ শিশুর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত রেকর্ড পরীক্ষায় বিজ্ঞানিরা দেখেছেন, “একদম ভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ঘটছে।”

এ গবেষণার সহ-প্রধান লেখক ও ম্যাসাচুসেটস জেনেরাল হসপিটাল ফর চিল্ড্রেনের পেডিয়ট্রিক গ্লোবাল হেলথ বিভাগের প্রধান ড. জেসন হ্যারিসকে উদ্ধৃত করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “শিশুদের মধ্যে আমরা যে ব্যাকটেরিয়া দেখেছি সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী হয়ে উঠতে পারে। গবেষণালব্ধ ফলাফল স্পষ্ট যে অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী জীবানু  মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এমন দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ এখন আর তাত্ত্বিক নয়, বরং এই সমস্যা ইতোমধ্যেই শেকড় গেড়ে বসেছে।”

“এসব শিশু ইতোমধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে অকালে মারা যাচ্ছে এবং একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ভয়াবহ সংক্রমণের সৃষ্টি হবে,” বলেন তিনি। 

ড. হ্যারিস বলেন, “এই গবেষণা ছিল বাংলাদেশের শুধু এক হাসপাতালে। সতের কোটি মানুষের একটি দেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ অঞ্চলজুড়ে যে অ্যান্টিবায়োটিক রোধের উদ্ভব হচ্ছে সেই সামগ্রিক সংখ্যাটি সম্ভবত বিশাল।"

বর্তমানের আরেকটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, “যখন বিশ্বের একটি অংশে এন্টিবায়োটিক-রোধী রোগজীবাণু সৃষ্টি হয়, তখন তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ যদি একটি জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে তবে উদ্ভবশীল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সমস্যা একটি বন্যার পানির মতো এবং বাংলাদেশের শিশুরা ইতোমধ্যেই এতে তলিয়ে যাচ্ছে।”

আইসিডিডিআর,বি’র নির্বাহী পরিচালক ও এ গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তাহমিদ আহমেদ বেনারকে বলেছেন, “বাংলাদেশে যেসব কারণে মানবদেহে জীবানুরা অ্যান্টিবায়োটিক রোধী হয়ে উঠছে তার সমাধান করা জরুরী।”

“এ দেশে ডাক্তারের পরমর্শ ছাড়াই দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে খাওয়ার চর্চা আছে। আমাশয়, সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো সাধারণ অসুখ হলে অনেকে মনে করেন, দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেলেই সেরে যাবে। অনেকে টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাতে চায় না। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বৃদ্ধি করে,” বলেন তিনি।

ড. তাহমিদ বলেন, অ্যান্টিবায়েটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে মনিটরিং দরকার। তা ছাড়া দেশে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ শনাক্ত করার মতো ল্যাবও অপ্রতুল। এ ছাড়া, সুপেয় পানি ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবও অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারের বড় কারণ।

নিউমোনিয়ায় দৈনিক ৬৭ শিশু মারা যায়

বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় তিনটি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় এবং আগামী দশকে নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও কিছু না করা হলে দেশে ১৪০,০০০ শিশু মারা যেতে পারে, গত বছরের নভেম্বর ও জানুয়ারী মাসে দুটি আলাদা প্রতিবেদনে জানিয়েছিল আইসিডিডিআর,বি এবং ইউনিসেফ।

বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস উপলক্ষে গত ১১ নভেম্বর আয়োজিত এক আলোচনায় আইসিডিডিআরবি’র গবেষকরা বলেছিলেন, বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৩ জন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বছরে ২৪ হাজার ৩০০ শিশুর মৃত্যুর হিসাব তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বলা হয়, এতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬৭ শিশুর মৃত্যু ঘটে।

আইসিডিডিআরবি’র মাতৃত্ব ও নবজাতক বিভাগের চিকিৎসক আহমেদ এহসানুর রহমান বলেছেন, “আমাদের দেশে যেসব শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় তাদের ৫২ শতাংশই চিকিৎসা ছাড়া বাসায় মারা যায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ৪৫ শতাংশ।

“নিউমোনিয়ার লক্ষণ থাকলে কোনওমতেই শিশুকে বাসায় রাখা যাবে না। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি আরও বেশি খেয়াল রাখা দরকার,” বেনারকে বলেন তিনি।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক রুহুল আমিন বলেছেন, “ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মায়ের দুধ পান করালে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে এবং নিউমোনিয়ায় কম আক্রান্ত হয়। পরিবেশ দূষণ নিউমোনিয়া বিস্তারের বড় কারণ।”

নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখলে শিশুদের অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে। বাসায় রেখে চিকিৎসা, বিশেষ করে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক দেওয়া একদম চলবে না। নিউমোনিয়ায় সময়মতো চিকিৎসা দিলে মৃত্যু এড়ানো যায়।

গত বছরের ২৯ জানুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউনিসেফ বলেছিল, “নিউমোনিয়া মোকাবিলায় আরও পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী দশকে বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হতে পারে। অপুষ্টি, বায়ু দূষণ এবং টিকা ছাড়াও অ্যান্টিবায়োটিক প্রাপ্তির অভাবকে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছিল, “এই রোগটি বাংলাদেশে শিশুদের অন্যতম বড় ঘাতক, যার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।