সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুরা
2024.12.20
ঢাকা
![সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুরা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুরা](https://www.benarnews.org/bengali/news/childhood-diabetes-12202024080816.html/@@images/9602dd1d-df22-4b89-bf2e-c2942586452b.jpeg)
আঠারো বছর আগে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সাদিয়া জান্নাত ইভার শরীরের ওজন ক্রমশ কমে আসছিল। সাথে ঘন ঘন প্রস্রাব। কোন রোগই ধরা পড়ছিল না।
তাঁর মা-বাবা পরীক্ষা করিয়ে দেখলেন ইভার ডায়াবেটিস (বহুমূত্ররোগ) হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে ‘বয়স্কদের রোগ’ বলে পরিচিত।
মানুষের এই ধারণার কারণে সামাজিক নানা যন্ত্রণার মধ্যে শৈশব ও কৈশোর কাটাতে হয়েছে বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার আইনজীবী ইভাকে।
রোগটি শনাক্ত হওয়ার পর দেখা যায়, তিনি টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যা থেকে বাঁচতে প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার ইনসুলিন নিতে হবে। তখন ইভার রক্তে সুগারের পরিমাণ ৩২।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, দেশে ডায়াবেটিক শিশুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০১০ সালে দেশে এই রোগী ছিল ৯০৩। ২০১২ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৮১৩।
২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ডায়াবেটিক শিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৫৪৭। এদের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত।
সংশ্লিষ্ট অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতে, ডায়াবেটিক শিশুদের বেশ কিছু সামাজিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
“স্কুলে জানাজানি হওয়ার পর আমি ছিলাম অনেকটা অচ্ছুতের মতো। আমার সহপাঠী এবং তাঁদের অভিভাবকদের কেউ কেউ বলত, আমার গায়ের সাথে গা লাগলে তাঁদেরও ডায়াবেটিস হবে,” এভাবেই বেনারের কাছে কষ্টের দিনের কথা স্মরণ করেন ইভা।
এসএসসি পাশ করে জামালপুর থেকে ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে আরেক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তিনি।
“তখনও আমি সাবালিকা নই। লালমাটিয়ায় মেয়েদের হোস্টেলে থাকতাম। একদিন রাতে আমি সিরিঞ্জ দিয়ে ইনসুলিন নিচ্ছিলাম। আমার রুমমেট তা দেখে হোস্টেল সুপারকে অভিযোগ করে, আমি ড্রাগ নেই।”
“উনি (শিক্ষক) না বুঝেই পুলিশ ডাকলেন। পুলিশও বিশ্বাস করতে চায় না যে, আমার মতো বাচ্চা মেয়ের ডায়াবেটিস হতে পারে,” বলছিলেন ইভা।
তিনি বলেন, “প্রেসক্রিপশন, ডায়াবেটিকের তথ্য থাকা বই দেখালাম। আরও বললাম, ফার্মেসিতে জিজ্ঞেস করতে। পরে অবশ্য বুঝতে পেরে পুলিশ চলে যায়।”
সেই রাতের কথা আজও ভুলতে পারে না সদ্য বিবাহিতা ইভা।
ইভার মতো আরও বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার তাজুল ইসলামকে।
তিনি বলেন, “১৪/১৫ বছর বয়সে আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। কলেজে ইনসুলিন নেওয়ার পরিবেশ ছিল না। অনেক সময় নোংরা টয়লেটে গিয়ে ইনসুলিন নিতে হয়েছে। কারণ কেউ দেখলে হয়তো বলবে, আমি ড্রাগ নিচ্ছি।”
তাজুল বলেন, “সবাই যখন জানল আমার ডায়াবেটিস, তখন সহপাঠী ও আত্নীয়-স্বজনদের কেউ কেউ বলত, আমি কদিন পর মরে যাবো। আমার কিডনি নষ্ট হয়ে যাবে। আমার বিয়ে বা সন্তান হবে না। এগুলো আমাকে মানসিক যন্ত্রণা দিত।”
বর্তমানে শিশু ডায়াবেটিক রোগীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন তাজুল। তিনি বলেন, “টাইপ-১ ডায়াবেটিস হলে রক্তে সুগারের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারবে না। মাঝারি মাত্রার থাকতে হবে।”
ঢাকার বারডেম মহিলা ও শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. বিদৌরা জাবিন বেনারকে বলেন, “বেশিরভাগ মানুষ জানে না যে, শিশুদের ডায়াবেটিস হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।”
তিনি বলেন, “আক্রান্তরা অনেক সময় এই রোগের কথা বলতে চান না, কারণ এই রোগ নিয়ে সমাজে স্টিগমা রয়েছে।”
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
মার্কিন গবেষণা সংস্থা সিডিসির মতে, টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না। অথবা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সেকারণে বেঁচে থাকতে তাদের নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়।
চিকিৎসকদের মতে, শিশুদের ডায়াবেটিস হলে সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন প্রচণ্ড পিপাসা পাবে, ঘনঘন প্রস্রাব হবে, ওজন কমে যাবে, সবসময় ক্লান্তি ভাব আসবে এবং শরীরে কোন ঘা থাকলে সেটি সহজে শুকাবে না।
ডা. বিদৌরা জানান, টাইপ-১ ডায়াবেটিস কেন হয়, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।
২৬ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে ইনসুলিন
বারডেমের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. সামিন তৈয়ব বেনারকে বলেন, অস্ট্রেলিয়া এবং ডেনমার্কের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের ডায়াবেটিক শিশুদের ২৬ বছর পর্যন্ত বিনা মূল্যে ইনসুলিন দেয়া হয়। তবে ২৬ বছরের পরও তো তাদের ইনসুলিন দরকার। সেটা গরিব মানুষ কিভাবে কিনবে, সেটি বড় প্রশ্ন।”
তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে ২৬ বছরের পরেও গরিব রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেয়া যায়।”
তিনি বলেন, “নিয়মিত ইনসুলিন নিয়ে নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিক শিশুরা সাধারণ সুস্থ মানুষের মতো বাঁচতে পারেন।”
বরিশাল থেকে ঢাকার বারডেম শিশু হাসপাতালে ১২ বছরের মেয়ের চিকিৎসা করাতে আসা নাজমা আখতার বেনারকে বলে, “আমরা চিন্তাও করতে পারিনি যে, আমার মেয়ের ডায়াবেটিস হতে পারে।”
বিভিন্ন উপসর্গের পর বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানে জানতে পারেন তাঁর মেয়ের ডায়াবেটিস হয়েছে এবং প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হবে।
নাজমা বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। কিভাবে প্রতিদিন দামি এই ওষুধ কিনবো? এখন ফ্রি ইনসুলিন পায়, সেজন্য মেয়ে ভালো আছে। কিন্তু বয়স ২৬ বছর পার হলে কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ”
ব্যতিক্রম জাহিনের সহপাঠিরা
প্রায় পাঁচ বছর আগে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ঢাকার মালিবাগের একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আফনান রহমান জাহিনের।
তাঁর মা নূর এ. ফারজানা বেনারকে বলেন, “অভিভাবকরা কানাঘুষা করে, এই মা বাচ্চার যত্ন নেয় না বলেই ডায়াবেটিস হয়েছে। অনেক অভিভাবক তাদের বাচ্চাকে আমার মেয়ের সাথে মিশতে মানা করতো। ”
ফারজানা বলেন, “আমার মেয়েকে সকাল আটটায় ইনসুলিন দিয়ে খাইয়ে স্কুলে নিয়ে যেতাম। আবার ১২টার দিকে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাকে খাইয়ে দিয়ে আসতাম। কারণ বাচ্চারা খেতে চায় না। আর না খেলে তো বড় বিপদ হতে পারে।”
ফারজানা বলেন, “স্কুল থেকে একবার আমার মেয়েকে খেলার প্রতিযোগিতায় নেবে না বলে জানাল। তাদের কথা, আমার মেয়ে খেলতে খেলতে হাইপো হয়ে যাবে।”
“আমি বললাম, সে খেলবে এবং দেখা গেল সে প্রতিযোগিতায় তিনটির মধ্যে দুটিতে প্রথম হলো। আমার মেয়ে লেখাপড়া ও খেলাধুলায় ভালো করছে,” জানান ফারজানা।
তার মতে, ডায়াবেটিক শিশুদের বিকাশের অন্যতম বাধা হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি।
“কিন্তু আশার কথা হলো, এখনকার বাচ্চারা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন, এখন আমার মেয়ের সহপাঠীরা বলে, এই জাহিন তোর খাওয়ার সময় হয়েছে, খেয়ে নে,” বলেন ফারজানা।