চীনা অর্থায়নে পায়রায় আবার নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.09.16
ঢাকা
চীনা অর্থায়নে পায়রায় আবার  নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র 1000 রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। ঢাকা, আগস্ট ২০, ২০১৬।
এপি

ভবিষ্যতে আর কোনো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে না—সরকারের এই ঘোষণার পরও নতুন করে চীনা অর্থায়নে আরেকটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে যাচ্ছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

নতুন প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে বর্তমান পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশেই। এটিরও উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১,৩২০ মেগাওয়াট।

গত মাসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঘোষণা দেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কোনো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে না।

তবে ২৪ আগস্ট বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সচিব নিরোদ চন্দ্র মণ্ডল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে পায়রা ১,৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

এই চিঠির একটি অনুলিপি বেনারের কাছে রয়েছে। উপ-সচিব নিরোদ চন্দ্র মন্ডল চিঠিটির সত্যতা বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন।

বলা হয়েছে, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ২,০৬৩ মিলিয়ন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড।

এই কোম্পানিটি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ধনখালী ইউনিয়নে বাস্তবায়নাধীন ১,৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র (প্রথম পর্যায়) বাস্তবায়ন করছে।

এটিই দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ইতিমধ্যে প্রথম পর্যায়ের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা শুরু হয়েছে। এ বছর অক্টোবরে পায়রা প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদন শুরু করবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটি চীন-বাংলাদেশের ডেট ইকুয়িটি অনুপাত হবে ৭৫ ভাগ ও ২৫ ভাগ। চীনা ব্যাংক সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ অর্থায়ন করবে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।

কি বললেন প্রতিমন্ত্রী?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বেনারকে বলেন, “এখন থেকে আমরা যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করব সেগুলোর সবগুলো গ্যাসভিত্তিক হবে । আমরা ভবিষ্যতে গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর নির্মাণ করা হবে না। তবে বর্তমানে যেসব কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে অথবা নির্মাণাধীন রয়েছে সেগুলো বাদ দেয়া হবে না।”

তিনি বলেন, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতার বাড়ি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করা হবে না ।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশেই আরেকটি ১,৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে । এটিও বাতিল করা হবে না।”

“এগুলো ছাড়া কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর বাস্তবায়ন করা হবে না ,” যোগ করেন তিনি।

সরকারের এই নীতিগত পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, “মূলত পরিবেশের কথা চিন্তা করেই আমরা ভবিষ্যতে আর কোনো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করব না । তা ছাড়া, আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়বহুল।”

এই প্রকল্পে অর্থায়ন সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে বেনারের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি ।

জ্বালানি বিষয়ক একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক অরুণ কর্মকার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে যে কয়লা আছে সেগুলো উত্তোলন করা যাচ্ছে না । সেকারণে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে প্রতি ইউনিট খরচ হবে প্রায় আট টাকা। অন্যদিকে এলএনজি (তরল গ্যাস) এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির খরচ কয়লার চেয়ে কম হবে।”

তিনি বলেন, “আবার এলএনজি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিবেশবান্ধব । সব মিলিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভালো।”

অরুণ কর্মকার বলেন, “বাংলাদেশের বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনায় বলা হয় যে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৫০ ভাগ কয়লা থেকে উৎপাদিত হবে । তবে সরকার এখন সেটিকে সর্বোচ্চ ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে চায়।”

তিনি বলেন, “বর্তমানে সরকার বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে । কিন্তু সেগুলো কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। এগুলোর বাস্তব অগ্রগতি শতকরা একভাগও নয়। সুতরাং, এই প্রকল্পগুলো বাতিল হলে কোনো অসুবিধা নেই।”

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশের দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াট । এগুলোর বেশির ভাগই গ্যাস-ভিত্তিক।

তবে সরকার কক্সবাজার জেলার মাতার বাড়িতে ১,২০০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০২৩ সালে এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে বলে সরকার আশা করছে।

ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবন এলাকার কাছে ১,৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান।

বাংলাদেশে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী সুশীল সমাজ আন্দোলনের অন্যতম নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো, কয়লাকে নোংরা উৎস হিসাবে চিহ্নিত করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লা বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে যাচ্ছে । আর আমরা কয়লাকে নতুন করে গ্রহণ করছি।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ । বিশেষ করে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়বে। সেখানকার প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়বে। সরকার নিজেই আবার পুরো উপকূলীয় এলাকায় কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে।”

কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, “বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির খরচ কয়লার চেয়ে কমে আসছে । সরকার সেদিকে যেতে পারে। আবার আমাদের সমুদ্রে যেগ্যাস সম্পদ আছে সেগুলো উত্তোলনের দিকে না গিয়ে কোম্পানিগুলোকে এবং তাদের এজেন্টদের পয়সা দেয়ার জন্য এই সকল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।”

তিনি বলেন, “একদিকে সরকার বলছে কয়লা আর ব্যবহার করা হবে না । আবার একই সঙ্গে তারা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের কাছে অর্থ সহায়তা চাইছে। এটি দ্বৈতনীতি। সরকারি নীতির পরিপন্থী।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বেনারকে বলেন, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। সেখানে বলা, দেশের সকল বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসভিত্তিক হবে।

অধ্যাপক তামিম বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে ২০১০ সালে এই মহাপরিকল্পনাটি পরিবর্তন করে বলা হয় দেশীয় কয়লা থেকে ৩০ ভাগ বিদ্যুৎ আসবে। এরপর দেশীয় কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

২০১৬ সালে পুনরায় মহাপরিকল্পনাটি পরিবর্তন করে বলা হয়, আমদানি করা কয়লা এবং তরল গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

অধ্যাপক তামিম বলেন, “আমি বরাবর যেকথাটি বলি, বর্তমানে আমাদের যে বিদ্যুৎ চাহিদা তা উৎপাদনের ক্ষমতার চেয়ে কম । সুতরাং, এই মুহূর্তে আমাদের আর নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র দরকার নেই। কারণ ২০২০ সালে আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদা ২৪ হাজার মেগাওয়াট হওয়ার কথা। কিন্তু সেটি বর্তমানে ১১ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি।”

তিনি বলেন, “চীনারা আমাদের কাছে কয়লা প্রযুক্তি বিক্রি করছে, সে কথা ঠিক । কিন্তু আমরা কিনছি বলেই চীনারা আমাদের কাছে নোংরা উৎসের বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পাছে। দোষটি ‍মূলত আমাদের।”

অধ্যাপক তামিম বলেন, “সরকার লম্বা সময়ের কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা করছে । আমার মনে হয়, পৃথিবীতে জ্বালানি খাতটি খুবই গতিশীল। একবারে ২০ বা ৩০ বছরের পরিকল্পনা না করে আমাদের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আমাদের উচিত পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করা। তাহলে বারবার পরিকল্পনা পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।