চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে আগুন, নিহত প্রায় অর্ধশত
2022.06.05
ঢাকা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের আট কর্মীসহ কমপক্ষে ৪৯জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা ২০০’র বেশি।
হতাহতের এই সংখ্যা নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যথাযথ চিকিৎসা প্রদান ও উদ্ধার কাজ চলছে। আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি দল।”
সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা বাসস।
আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেবার পাশাপাশি দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণ, উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য সরকারের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে আগুন লাগার প্রায় ২০ ঘণ্টা পার হলেও রোববার রাত সাড়ে আটটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করার সময় রাসায়নিক থাকা একটি কনটেইনারে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।
ইলিয়াস জানান, রাতেই আহতদের অধিকাংশকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এবং এর পাশাপাশি চট্টগ্রামের অন্যান্য হাসপাতালেও অনেকে ভর্তি হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, বিস্ফোরণে আক্রান্তদের অনেকের হাত-পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
বিএম কনটেইনার ডিপোতে কী ধরনের রাসায়নিক ছিল জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহাম্মদ নায়েব আলী বেনারকে জানান, কী ধরনের রাসায়নিক ছিল, সেই তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।
“আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল, যদি তাই থেকে থাকে তাহলে তা আমদের কাজের তালিকার মধ্যে পড়ে না,” বলেন নায়েব।
তবে আগুন লাগার কারণ এখনো জানতে পারেননি জানিয়ে বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মজিবুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা সন্দেহ করছি যে, কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।”
“আমরা আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি এবং হতাহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ আমরা বহন করব। দুর্ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং নিহতদের পরিবারের সকলের দেখভাল করা হবে,” যোগ করেন তিনি।

হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি
ছোট ভাই মো. মনিরের (৩২) খোঁজে এসেছেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা আব্দুল করিম। মনির বিএম কনটেইনার ডিপোতে কাজ করতেন এফএলটি অপারেটর হিসেবে।
গতকাল রাতেও সন্তান-সম্ভবা স্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মনির। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) সব ইউনিট খুঁজেও ছোট ভাইয়ের সন্ধান পাননি বড়ো ভাই আব্দুল করিম। খোঁজ পেতে তাই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নুরুল কাদের চাকরি করতেন ডিপোর ওয়ার্কশপ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। চাচাতো ভাই মনির হোসেন পুরো হাসপাতাল খুঁজে বেড়াচ্ছেন নুরুল কাদেরের খোঁজে। তবে এখনো তাঁর খোঁজ মেলেনি।
আব্দুস সুবহান (৩১) কন্টেইনার ডিপোর আইসিটি সুপারভাইজার হিসেবে চাকরিরত ২০১৩ সাল থেকে। মিলছে না তাঁর খোঁজও। তাঁর চাচাতো ভাইয়েরা সন্ধান করে চলেছেন আব্দুস সুবহানের।
এ রকমভাবে স্বজনের খোঁজে এসেছেন আরও অনেকে। খোঁজ না পেয়ে ভেঙে পড়ছেন কান্নায়।
ওই ঘটনায় আহত দুই শতাধিক এখন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আশরাফ উদ্দিন।
তিনি জানান, ১৫ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
উদ্ধারকৃত মরদেহগুলো হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে বলে বেনারকে জানান চমেক পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।

বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে আশপাশের এলাকা
প্রত্যক্ষদর্শী ও হতাহতদের স্বজনরা গণমাধ্যমে বলেছেন, ওই ডিপোতে ৫০ হাজারের বেশি কনটেইনার রয়েছে। আগুন লাগার পর কনটেইনারগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থল থেকে তিন-চার কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে এবং আশপাশের বাড়ি-ঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে।
ঘটনাস্থল থেকে সাত কিলোমিটার দূরের কুমিরা ইউনিয়নের কোর্টপাড়া গ্রামের খোদেজা কবির (৫৭) বেনারকে বলেন, বিস্ফোরণের ভয়াবহতা তাঁরা সেখান থেকেই টের পেয়েছেন।
“রাতে আমাদের পুরো এলাকা বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠে। আমরা ধারণা করেছিলাম ভূমিকম্প। পরবর্তীতে আমরা এই অগ্নিকাণ্ডের কথা জানতে পারি,” বলেন তিনি।
অগ্নিদগ্ধদের জরুরি চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের সব চিকিৎসকের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে দুই কমিটি
বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি এবং ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রবিবার দুপুরে এই কমিটি দুটি গঠন করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার।
রবিবার বেলা সাড়ে ১২টার পর বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষের প্রতিনিধি কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক শহীদ উদ্দিন সংবাদ মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়ে এই ঘটনা দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।
এদিকে, এই বিস্ফোরণের ঘটনা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তা তদন্ত করার দাবি তুলেছেন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ।
বিএনপির এই সদস্য ডিপোর মালিকদেরকে গ্রেপ্তারেরও দাবি করেন।

হতাহতদের সহায়তায় বরাদ্দ ১ কোটি টাকা
হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা হিসেবে নগদ এক কোটি টাকা এবং এক হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নেদারল্যান্ড-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার ২৪ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপো মূলত পণ্য রপ্তানিতে কাজ করে। ৩৮ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি এবং ঘটনার সময় সেখানে ৫০ হাজার কনটেইনার ছিল।
বিএম কনটেইনারের কর্মকর্তা শামছুল হায়দার সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে মোট কর্মীর সংখ্যা তিন হাজারের মতো।
তিনি জানান, রাতে ঘটনার সময় প্রায় ১৫০জন কর্মী কর্মরত ছিলেন।
ডিপোর চেয়ারম্যান ডাচ ব্যবসায়ী বার্ট প্রঙ্ক, যার বাংলাদেশেও অন্যান্য বিনিয়োগ রয়েছে, আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন স্মার্ট গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মুস্তাফিজুর রহমান।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর নবাব কাটরার নিমতলি এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কমপক্ষে ১১৭ জন মানুষ নিহত হন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আব্দুর রহমান।