পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারে নিহত ১২

জেসমিন পাপড়ি
2018.06.12
ঢাকা
রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া সড়ক মেরামতের কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া সড়ক মেরামতের কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। ১২ জুন ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

পাহাড় ধসে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারে নারী ও শিশুসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টির মধ্যে মঙ্গলবার রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ১১ জন ও কক্সবাজারের উখিয়ায় জামতলি রোহিঙ্গা শিবিরে একজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়।

“গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধস শুরু হয়েছে। এই ধসে মঙ্গলবার উপজেলার ধর্মচরণ কারবারি পাড়ায় একই পরিবারের চারজন, বড়পুল পাড়ায় দুই পরিবারের চারজন, হাতিমারা এলাকায় দুজন এবং গিলাছড়ি ইউনিয়নের মনতলা এলাকায় একজন মারা গেছেন,” বেনারকে জানান রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা।

উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে গাছ চাপায় নিহত রোহিঙ্গা যুবকের নাম মোহাম্মদ আলী (২০) বলে বেনারকে জানান উখিয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের। আট মাস আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে সেখানে আশ্রয় নেন তিনি।

মঙ্গলবার সকালের ভারী বৃষ্টিতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পাচঁটি রোহিঙ্গা শিবিরে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও পানিতে তলিয়ে গেছে বলেও বেনারকে জানান উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজাম্মান চৌধুরী।

“এসব রোহিঙ্গা পরিবারের একটি তালিকা করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারকে অন্যত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার অনেকে আত্মীয়স্বজনদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে,” বলেন তিনি।

এদিকে টানা এই বৃষ্টিতে রাঙ্গামাটির অন্যান্য স্থানেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। প্রবল বর্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার সড়ক যোগাযোগ। এই দুর্যোগ আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত নানিয়ারচরে তিনটি স্থানে এবং জেলা সদরসহ সব মিলিয়ে ২০টির মতো ভূমিধস হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ।

এভাবে টানা বৃষ্টি হতে থাকলে আরও ভূমিধস হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁর।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাহাড় ধসের কারণে বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় ওই এলাকাগুলোতে উদ্ধার কাজের গতি কিছুটা শ্লথ।

তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার বেনারকে জানান, উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন।

ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ জানান, এখন পর্যন্ত একুশটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে মানুষজনকে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এর আগে গত বছর ১৩ জুন টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে ১৩০ জন নিহত হন। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে চার সেনাসহ ৯৮ জন, বান্দরবানে ৭ জন এবং চট্টগ্রামে ২৫ জন মারা যান। তবে সেবার নানিয়ারচরে কেউ নিহত হয়নি।

পাহাড়ে অবৈধ বসতি বাড়তে থাকায় প্রতিবছরেই ভূমি ধসের আশঙ্কা বাড়ছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বেনারকে বলেন, প্রশাসনের নিশ্চুপ থাকার সুযোগে অবাধে পাহাড় দখল ও অবৈধ বসতি স্থাপন চলছে। ফলে প্রতিবছর ভূমি ধসে প্রাণহানিও বাড়ছে।

তবে এবার লাখ লাখ রোহিঙ্গা পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ায় এই ঝুঁকি আরও বেশি বলে মনে করেন তিনি।

নাসের খান বলেন, “রোহিঙ্গারা আসায় যেভাবে পাহাড় কাটা হয়েছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে এবার আরও ব্যাপক পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছি।

“তারা (রোহিঙ্গা) পাহাড় কেটে বাসস্থান বানানোর নানা উপকরণ এবং জ্বালানিও এসব পাহাড় বা বন থেকে সংগ্রহ করে। ফলে প্রতিদিনই পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে,” তিনি বলেন।

চলছে অবৈধ বসতি

এদিকে রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধ বসতি নির্মাণ চলছেই। গত বছর পাহাড় ধসের পরে গত এক বছরের মধ্যেই অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ১২টি পাহাড়ে দুই শতাধিক নতুন ঘর নির্মিত হয়েছে। ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ এই পাহাড়গুলোতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। ভারী বৃষ্টিতে এসব ঘর বিধ্বস্ত হয়ে নতুন করে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত বছরের পাহাড়ধসের ঘটনায় স্বল্প, দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল জেলা প্রশাসন গঠিত অনুসন্ধান কমিটি। কিন্তু এক বছরেও এ সুপারিশের বেশির ভাগ বাস্তবায়ন হয়নি।

চট্টগ্রামেও পাহাড় ধসের আশঙ্কা

রাঙ্গামাটির মতো চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় কয়েক দিনের টানা বর্ষণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

ইতিমধ্যে সোমবার ও মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করা লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।

“পাহাড় ধসের ভয়াবহতা এড়াতে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক মাইকিং চালানো হচ্ছে” বলে বেনারকে জানান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভুঞা।

গত বছর ১৩ জুন রাঙ্গামাটির মতো চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ধসের ঘটনায় রাজা নগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে ২২ জন মানুষ মারা যায়।

এ বছরও অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পাহাড় ধসের আশঙ্কায় রয়েছেন বলে জানান আহসানুল কাদের।

ক্ষতিগ্রস্ত ১১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা

গত ১০ জুন থেকে শুরু হওয়া বর্ষা ও ভূমিধসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রায় ১১ হাজার শরণার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মঙ্গলবার জেনেভা থেকে এক বিবৃতিতে জানায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

“এক হাজারের বেশি ঘর, দশটি পানির উৎস, ১৬৭টি টয়লেট, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,” বিবৃতিতে জানান ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র অ্যান্দ্রেজ মাহিচিচ।

গত সোমবার উখিয়ায় পাহাড় ধসে নিহত রোহিঙ্গা শিশুর কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, বৃষ্টিতে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের প্রধান সড়কও তলিয়ে গেছে।

ভূমিধসের আশঙ্কায় থাকা প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন জানিয়ে মাহিচিচ বলেন, “এদের মধ্যে ৪১ হাজারের বেশি মানুষ রয়েছেন ভূমিধসের চরম ঝুঁকিতে।”

এখন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো থেকে ১৪ হাজার শরণার্থীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

বর্ষা ও পাহাড়ধস পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইউএনএইচসিআরসহ অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান অ্যান্দ্রেজ মাহিচিচ।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।