দেশে প্রথমবারের মতো ঘর পেলেন ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার

সুনীল বড়ুয়া ও কামরান রেজা চৌধুরী
2020.07.23
কক্সবাজার ও ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
200723_Climate_Refugee_1000.jpg গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কক্সবাজারে গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৩ জুলাই ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের খুরুশকুলে বাঁকখালী নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য দেশের প্রথম আশ্রয়কেন্দ্র।

প্রথম ধাপে পাঁচতলা ২০টি ভবনে ফ্ল্যাট পেয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু ৬০০টি পরিবার যারা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তাঁদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এক হাজার এক টাকা নামমাত্র মূল্যে এসব ফ্ল্যাট তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনারা এত দিন যেভাবে ছিলেন কষ্টের মধ্যে, আমি নিজে গিয়েছি, দেখেছি সেটা। এখন আপনারা সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারবেন।”

এ সময় বৃক্ষরোপণ করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখানে নদীর কূল ধরে সবুজ বেষ্টনী করে দেওয়া হবে। কোনো ধরনের ঝড় জলোচ্ছ্বাসে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং আপনারাও ব্যাপকভাবে একটু বৃক্ষরোপণ করবেন।”

পুনর্বাসিতদের জীবিকার সুযোগও করে দেয়া হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আবসার বেনারকে জানান, ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উদ্বাস্তু হওয়া লোকজন এর আগে কক্সবাজার বিমানবন্দর সংলগ্ন সমিতিপাড়া, কুতুবদীয়া পাড়াসহ আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ওইসব এলাকায় বর্তমানে বসবাসরত চার হাজার ৪০৯ পরিবারের লোকজনকে পুনর্বাসিত করতে খুরুশকূলের ২৫৩ দশমিক ৩৫ একর জমিতে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পটি তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

শহরের খুরুশকুলের বাঁকখালী নদীর তীরে সরকারের নিজস্ব ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে পাঁচতলা ২০টি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ১৩৯টি ভবন নির্মাণ করা হবে। ১৩৯টি ভবনের কাজ শেষ হলে ফ্ল্যাট পাবে চার হাজার ৪০৯ পরিবার।

জেলা প্রশাসক জানান, প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট থাকবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সিলিন্ডার এবং প্রতিটি ভবনে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল থাকবে।

২০২৩ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে তিনি জানান।

প্রকল্প এলাকায় খেলার মাঠ, খোলা জায়গা, প্রশস্ত রাস্তা, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, পুকুর, মসজিদ-মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সুবিধা থাকবে বলে বেনারকে জানান প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন।

“এটিই দেশের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য দেশের প্রথম আবাসন প্রকল্প,” বলেন মাহবুব হোসেন।

কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত পাঁচতলা ভবন। ১০ জুলাই ২০২০।
কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত পাঁচতলা ভবন। ১০ জুলাই ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

খুশি উদ্বাস্তুরা

পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে শহরের ফদনারডেইল এলাকায় বসবাস করতেন জুবাইদা নাসরিন (৫০)। এখন আশ্রয় কেন্দ্রে নতুন ফ্ল্যাট পেয়েছেন তিনি।

“আগে যাতায়াত নিয়ে খুবই অসুবিধায় ছিলাম। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যেতে সমস্যা হতো। সারা বছর পানিন্দি থাকতাম। এখন সেই ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলেছে। এই জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ,” বেনারকে বলেন জুবাইদা।

একই এলাকার মো. হানিফ (৩০) বেনারকে বলেন, “১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ঘরবাড়ি সাগরে চলে গেলো। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারি জায়গায় বস্তিতে থাকতাম। আজ এখানে, কাল ওখানে। এ রকম পাকা ভবন পেলে কে খুশি হবে না? আমরাও খুব খুশি।”

বৃদ্ধ শাহা আলম বলেন, “৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে অনেক স্বজনকে হারিয়েছি। এরপর এখানে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সরকার আমাদের বিল্ডিং দিচ্ছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে!”

জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র প্রতিনিধি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, “সমুদ্র উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় বন্যার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চার কোটি ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।”

“বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার, যদিও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই চার কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে বিরাট অংশের মানুষের বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাবে। তারা জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।”

তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সমস্যার কথা বলে আসছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনকি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কথা বলে আসছেন।

“জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সরকারি অর্থায়নে আবাসনের ব্যবস্থা নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা ছিল। বলা যায় বিভিন্ন সমস্যার কারণে হয়তো এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লেগেছে,” বলেন জিয়াউল হক।

“বাংলাদেশে এই প্রথম জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা করা হলো। আমার জানা মতে বিশ্বে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশেষ আবাসন ব্যবস্থা বিশ্বে এটাই প্রথম,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।