কঠোর সমালোচনার মধ্যেও কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চলছেই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.06.21
Crossfire-Again620.jpg ক্রসফায়ার বন্ধের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করে। জুন ২১, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে কঠোর সমালোচনার মধ্যেও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন আসামিরা মারা যাচ্ছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

গতকাল মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ডাকাতি মামলার আসামি আবদুস সাত্তার (৩২) নিহত হন ।  তাকে একদিন আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।

পুলিশ হেফাজতে আসামি মারা যাওয়ার ঘটনায় মানবাধিকার কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। কিন্তু পুলিশ যুক্তি দিচ্ছে, আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছুড়তে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও এই যুক্তির ওপর আস্থা নেই মানবাধিকার কর্মীদের।

“ভোরে উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের রসুলপুর কবরস্থানের কাছে এ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়,” বেনারকে জানান সরাইল থানা পুলিশের ওসি রূপক কুমার সাহা। তিনি বলেন, সাত্তার আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য ছিল, তার বিরুদ্ধে সরাইল থানায় ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে।

রূপক কুমার বলেন, অস্ত্র ও ডাকাতিসহ আট মামলার আসামি সাত্তারকে সোমবার রসুলপুর গ্রামের রিফিউজিপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী রসুলপুর কবরস্থানের পেছনে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে সাত্তারের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়লে সাত্তার ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

ঘটনাস্থল থেকে একটি পাইপগান, এক রাউন্ড গুলি ও ছয়টি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।

এদিকে ক্রসফায়ারে হত্যার ঘটনাগুলো নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম (১৯)। হাতেনাতে ধরা পড়া ওই তরুণকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার পর প্রথম দিন সকালেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ফাহিম।

এরপর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই শনিবার ভোররাতে ঢাকার খিলগাঁওয়ে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে একই রকম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় অভিজিৎ রায় হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন শরিফ।

এই দুজন জঙ্গিকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার বিরোধিতা করে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বরং তাদের বাঁচিয়ে রেখেই জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা যেত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। গুপ্তহত্যা, পরিকল্পিত হত্যা ও বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনাগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম দৃষ্টান্ত।”

তাঁর মতে, অপরাধী যেই হোক না কেন বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাই সমর্থনযোগ্য নয়।

এদিকে কথিত বন্দুক যুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘দুর্বলতা’ বলে মনে করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে তিনি বলেন, প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে, ক্রসফায়ারে জঙ্গি বা অন্য কেউ নিহত হচ্ছে।

“এটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা ও দুর্বলতা,” বলেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

এর আগে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগিরও ক্রসফায়ারে হত্যার সমালোচনা করেছেন।

দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার বিপক্ষে প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও কলাম ছাপা হচ্ছে।

“আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সব মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করার কথা বলে । জঘন্য খুনিকেও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে বলে,” লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক লেখায় তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমরা বিচার করে শাস্তি দিয়েছি। একাত্তরের ঘাতকদেরও আমরা শাস্তি দিয়েছি বিচার করার পর। তাহলে অভিযুক্ত জঙ্গি বা ভিন্নমতাবলম্বী লোকজনদের কেন মেরে ফেলা হচ্ছে কোনো বিচার না করে? কেন তারা দোষী কি না তা নির্ণীত হওয়ার আগেই প্রাণ হারাচ্ছে?”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।