চীনের পর পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনাভাইরাস: সংকটে তৈরি পোশাক শিল্প
2020.03.05
ঢাকা
বাংলাদেশে কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রধান দেশ চীনে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আগেই ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসের বিস্তার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের শতকরা ৮৫ ভাগ বিক্রি হয় পশ্চিমা দেশগুলোতে। করোনাভাইরাস বিস্তৃত হলে সেখানকার ক্রেতারা পণ্য কিনবেন না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
“আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত গত আট মাস ধরে ঋণাত্মক ধারায়। যেখানে আমরা আশা করেছিলাম এ বছর কমপক্ষে ১০ ভাগ ব্যবসা বৃদ্ধি হবে, সেখানে সাড়ে পাঁচ ভাগ কমে গেছে,” বেনারকে বলেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
গত ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৪০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে পোশাক খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা মোট আয়ের ৮৪ শতাংশ।
“করোনাভাইরাস সরবরাহ লাইনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আমরা চীন থেকে তুলা, সুতা, মেশিন, কেমিক্যালসহ তৈরি পোশাকের প্রায় সামগ্রী আমদানি করি। এত তাড়াতাড়ি অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা কঠিন। সুতরাং, প্রভাব পড়ছে। তবে কতটুকু পড়েছে তা এখনই সংখ্যা দিয়ে বলা যাবে না,” বলেন সিদ্দিকুর রহমান।
বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের শতকরা ৮৫ ভাগ ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডায় বিক্রি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সামনে বড় বিপদ আসছে বলে মনে হয়। করোনাভাইরাস ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ছে।”
তাঁর মতে, পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনার প্রাদুর্ভাব হলে মানুষজন পুরোপুরি ঘরে বসে থাকবে। আর সে ক্ষেত্রে ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করে দেবে।
“ইতিমধ্যে অনেক ক্রেতা অর্ডার বাতিল করেছে,” বলেন সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, “চীনে যদি সমস্যা হয় তাহলে আমরা অন্য কোনো দেশ থেকে কাঁচামাল আনতে পারব; হয়তো তারা দাম বেশি নেবে। কিন্তু যদি চাহিদা না থাকে, ক্রেতা না থাকে তাহলে উৎপাদন করে লাভ কী?”
বাংলাদেশের ওভেন পোশাক প্রস্তুতকারীরা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ সুতা, তুলা, রাসায়নিক ও অন্যান্য কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করে থাকেন বলে বেনারকে জানান নিটভ্যালি লিমিটেডের প্রধান আব্দুল ওয়াদুদ।
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে আমরা তুলাসহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি করতে পারছি না।”
“প্রথম কারণ হলো ক্রেতাদের একটি বড় অংশ চীন থেকে আমদানি করা কাঁচামালে তৈরি করা সামগ্রী নেবে না বলে জানিয়েছে। আবার আমাদের সরকারের পক্ষ থেকেও চীন থেকে আমদানিতে কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে,” বলেন আব্দুল ওয়াদুদ।
নিটের ক্ষেত্রে তাঁর কোম্পানির উৎপাদন শতকরা ২০ ভাগ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আর ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ ভাগ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সংকট বনাম সম্ভাবনা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “সার্বিকভাবে, চীন থেকে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের শতকরা ৪০ ভাগ কাঁচামাল আসে। আর আমাদের মোট আমদানির শতকরা ২৫ ভাগ চীন সরবরাহ করে।”
“সুতরাং, চীনে করোনাভাইরাস আক্রমণের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটিই স্বাভাবিক। তবে এখনই বলা যাবে না কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে,” বলেন তিনি।
তবে করোনাভাইরাসের কারণে চীনে যারা বিনিয়োগ করেছে তারা চীনের বিকল্প কোনো দেশে বিনিয়োগের চিন্তা করবে মন্তব্য করে ড. মোস্তাফিজুর বলেন, “আমরা সেই সুযোগ নিতে পারি।”
চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কত ক্ষতি হবে, আর সার্বিকভাবে রপ্তানি আয়ে কতটুকু প্রভাব পড়বে তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন বলে জানান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর।
তিনি বেনারকে বলেন, “চীন থেকে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কিনতে বছরে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। চীনের পরিবর্তে অন্য দেশ থেকে এত বিশাল অঙ্কের আমদানি করা সহজ নয়।”
নিট শিল্পের কাঁচামালের প্রায় ৯০ ভাগ দেশেই তৈরি হয় বলে এই ক্ষেত্রে চীনা সরবরাহ বাদ দিয়েও বাংলাদেশ সামলে নিতে পারবে বলে জানান আহসান মনসুর।
“সমস্যা হবে ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে। আমরা মূলত চীন থেকে ওভেন পোশাকের ৪০ ভাগ ইয়ার্ন নিয়ে আসি,” বলেন তিনি।
এদিকে “চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে আমাদের জন্য সুযোগও তৈরি হবে,” মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, “চীনে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সারা বিশ্বের সরবরাহ চ্যানেল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই, বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ এখন চীন থেকে সরে আসবে; অন্যত্র বিনিয়োগ করবে।”
“তাই, আমাদের এই সুযোগ গ্রহণ করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
চীনে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে সরবরাহ চেইনের সমস্যা মোকাবিলা করছে বলে জানান আহসান। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়লে আমাদের তখন চাহিদা চেইনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।
“পশ্চিমা দেশে সংক্রমণ হলে সেটি হবে আমাদের জন্য মারাত্মক সমস্যা,” যোগ করেন আহসান।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বেনারকে বলেন, “দেখুন তৈরি পোশাক খাতে কিছুটা তো প্রভাব পড়ছে। কিন্তু কতটুকু প্রভাব পড়ছে তা এখন পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমরা আগামী মে মাসে বুঝতে পারব যে করোনাভাইরাস আমাদের কতটা ক্ষতি করেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা বলতে পারছি না চীনে সমস্যাটি কত দিন থাকবে। তবে চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে করোনভাইরাস পরিস্থিতি খারাপ হয়নি। উন্নতির দিকে। সুতরাং, আশা করি অল্পদিনে মধ্যে সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক হয়ে আসবে।”
করোনাভাইরাস বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, বৃহস্পতিবার তা জানতে চেয়েছে উচ্চ আদালত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এ ব্যাপারে তিনটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে- এমন সংবাদ নজরে আনা হলে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার মৌখিকভাবে এ নির্দেশনা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
বেনারকে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আগামী সোমবারের মধ্যে এ বিষয়ক অগ্রগতি জানতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁকে আদালতের নির্দেশনাগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এখন পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে পাঁচজন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইটালিতে একজন করে মোট সাতজন প্রবাসী বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বাংলাদেশের ভেতরে এখন পর্যন্ত এই রোগে কেউ আক্রান্ত হননি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।