ইতালি থেকে করোনা এসেছে বাংলাদেশে, তিনজন শনাক্ত
2020.03.08
ঢাকা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এমন তিনজনকে শনিবার শনাক্ত করেছে দেশটির রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।
এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে মুজিববর্ষের কর্মসূচি পুনর্বিন্যাস ও সংক্ষিপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী রোববার রাতে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
“মুজিববর্ষ উপলক্ষে বড় পরিসরে জনসমাগম করা হবে না। ১৭ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানও হচ্ছে না, এটা পরে সুবিধাজনক সময় হবে। এ ছাড়া বছরব্যাপী ছোট পরিসরে কর্মসূচি পালন করা হবে,” জানান কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী।
উল্লেখ্য, ব্যাপক আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচি শুরু করেছে সরকার, যা শেষ হবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ। ওই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কয়েকজন বিশ্বনেতার যোগ দেওয়ার কথা ছিল।
কামাল নাসের চৌধুরী জানান, “বিশ্ব পরিস্থিতি, জনস্বার্থ এবং জনকল্যাণে এই কর্মসূচি কাটছাঁট করা হয়েছে।
আক্রান্ত দুই পুরুষ, এক নারী
আইইডিসিআর–এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা রোববার সাংবাদিকদের জানান, ভিন্ন পরিবারের দুই পুরুষ ইতালি থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছেন। পরে সংক্রমণের শিকার হয়েছেন এক নারী। আক্রান্তদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
“দেশে ফেরার পর শরীরে লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা গেলে তাঁরা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন। যার ভিত্তিতে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করলে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। দুই পরিবারের আরও চারজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে একজনের পরিবারের এক নারী সদস্যের শরীরেও করোনা পাওয়া গেছে,” বলেন তিনি।
তিনি জানান, বর্তমানে এই তিনজন একটি হাসপাতালের ‘আইসোলেশন’ বিভাগে রয়েছেন। তবে সেটি কোন হাসপাতাল তা উল্লেথ করেননি তিনি।
“আক্রান্ত ব্যক্তিরা বাদেও আরও তিনজনকে আলাদা করে রাখা হয়েছে,” বলেন সেব্রিনা।
আতঙ্ক নয়, সাবধান থাকতে হবে
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১০ বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এর আগে সিঙ্গাপুরে পাঁচজন এবং আরব আমিরাত ও ইতালিতে একজন করে বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের পর বাংলাদেশে সংক্রমণের এই খবর এলো।
“এই সংবাদে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং সবাইকে সাবধান হতে হবে। আমরা সবাই যদি সচেতন না হই, সাবধান না থাকি, তবে সরকার একা কিছুই করতে পারবে না,” বেনারকে বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক।
বাংলাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার মতো কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি দাবি করে রোগতত্ত্ববিদ সেব্রিনা বলেন, “আশঙ্কা করছি না আরও ছড়িয়ে পড়বে। প্রত্যেকের মাস্ক পরে ঘুরে বেড়ানোর কোনো দরকার নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।”
তবে ড. রুহুল বলেন, “যে কোনো গণজমায়েত ঠেকাতে খুব দ্রুত সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে পাবলিক প্লেস এবং পরিবহনগুলো কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, সেটিও ভাবতে হবে।”
করোনার ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সবাইকে জনসমাগমে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন সেব্রিনাও।
প্রস্তুত আছে বাংলাদেশ
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে আইইডিসিআর পরিচালক সেব্রিনা বলেন, “এর আগে সরকারি প্রতিটি হাসপাতালে ‘আইসোলেশন ইউনিট’ করা হয়েছিল, এখন সারা দেশের ‘আইসোলেটেড’ হাসপাতালগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে।”
একইদিন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে।
“উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে,” উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “২৪ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কোনো জায়গায় সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নির্দেশনা দিচ্ছে।”
পরবর্তীতে রোগী বৃদ্ধি পেলে স্কুল-কলেজ এবং কমিউনিটি সেন্টারকে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতিও সরকারের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন সেব্রিনা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের সব হাসপাতালে চিকিৎসকদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এরই মধ্যে চীন, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান ও থাইল্যান্ড, এই ছয়টি দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা সব যাত্রীকে বিচ্ছিন্ন (কোয়ারেন্টাইনে) রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে শনিবার বাংলাদেশসহ সাতটি দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় কুয়েতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পৃথক দুটি প্রতিবেদনে করোনার প্রভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার বলেন, “করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে বর্তমানে অনেক দেশই অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।”
একইদিন ঢাকায় অপর এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি দাবি করেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এর আগে বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, “চীন যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, তবে তা সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলবে।”
অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের রপ্তানি শিল্পে যে ধরনের কাঁচামাল দরকার হয়, তার সিংহভাগই আমরা চীন থেকে আমদানি করে থাকি। আমাদের মোট আমদানি পণ্যের ২৬ শতাংশ সেখান থেকে আসে। যার বড় অংশই পোশাক শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ।”
“এগুলোর বিকল্প উৎস বের করতে সময় লাগবে, আবার পাওয়া গেলেও দামটা বেশি হবে,” উল্লেখ করে ২০০৭-০৮ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা আজিজুল আরো বলেন, “করোনার প্রভাবে শুধু আমাদের রপ্তানি আয় নয়, এ দেশে চীনা বিনিয়োগও কমে যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে চলমান বড় প্রকল্পগুলোও।”
বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে চীনাদের অংশগ্রহণ রয়েছে পদ্মা সেতু, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাস-র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), কর্ণফুলী টানেলসহ অনেকগুলো বড় প্রকল্পে।
সরকারি নির্দেশনা
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে দেওয়া নির্দেশনায় সরকার বলেছে, “এ রোগের কোনো উপসর্গ যেমন জ্বর, গলাব্যথা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসকষ্টের সাথে কাশি দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রুহুলও বেনারকে বলেন, “এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার তিন শতাংশের বেশি নয়, যেটা অন্য অনেক ভাইরাসের চেয়ে কম। তবে লক্ষণ গোপন না রেখে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।”
সরকারি তথ্য বিবরণীতে আরও বলা হয়, “জনবহুল স্থানে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং পোষা প্রাণীর সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে। বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে এবং খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। খাবার ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে।”
“মুখে হাত না দিয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়া এবং যেখানে সেখানে থুতু ও কফ ফেলার অভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে,” বলেন ড. রুহুল।