করোনা মহামারির এক বছর: ঢিলেঢালা স্বাস্থ্যবিধি, সংক্রমণ বাড়ছে আবার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.03.08
ঢাকা
করোনা মহামারির এক বছর: ঢিলেঢালা স্বাস্থ্যবিধি, সংক্রমণ বাড়ছে আবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এক রোগীকে করোনাভাইরাসের টিকা দিচ্ছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ৮ মার্চ ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার এক বছর হলো সোমবার। বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মহামারি পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হলেও বছর পূর্তির দিকে সংক্রমণর হার আবারো বাড়তে শুরু করেছে। 

এজন্য স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার প্রবণতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে। 

গত বছরের ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত করে সরকার। গত এক বছরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ছিল তুলনামূলক কম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ লাখের মতো মানুষ, এই রোগে মারা গেছেন প্রায় সাড়ে আট হাজার।

বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।

ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ.এস.এম. আলমগীর সোমবার বেনারকে জানান, “বাংলাদেশে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আশঙ্কা করা হয়েছিল এখানে সংক্রমণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছবে। কিন্তু অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে গত এক বছরে বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলা করেছে।”

চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষিত নমুনার বিপরীতে সংক্রমণের হার নেমে আসে শতকরা দুই থেকে তিন ভাগে। তবে মার্চে এসে সংক্রমণের হার আবার বাড়তে শুরু করেছে। 

“জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণের হার কমে শতকরা দুই ভাগ বা তারও নিচে নেমে আসে, যা গত কয়েকদিনে আবার বাড়ছে,” জানিয়ে ড. আলমগীর বলেন, “সর্বশেষ সংক্রমণের হার চার দশমিক তিন, এটা পাঁচের ওপরে গেলে আবার সমস্যায় পড়ব আমরা।” 

“বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। জনগণ আগের মতো ফ্রি স্টাইলে চলাফেরা শুরু করেছে। সংক্রমণ কম হওয়ায় মানুষের মধ্যে একটি ধারণা এসেছে, এটি চলে গেছে। আবার টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়ার ফলে মানুষ মনে করছে টিকা দিলে আর কিছুই হবে না, যদিও এসব ধারনা ঠিক নয়,” বলেন ড. আলমগীর। 

টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে

গত বছর ৮ মার্চ প্রথম তিনজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্তের কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট। ১৮ মার্চ এই রোগে বাংলাদেশে প্রথম একজন মারা যান। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। জুন-জুলাই মাসে এই সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। 

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কয়েকদফা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে জুন মাস থেকে ছুটি শিথিল করা হলে বাড়তে থাকে সংক্রমণ।

গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এক বছর পর স্কুল–কলেজ খুলবে আগামী ৩০ মার্চ, আর বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে ২৪ মে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২ জুলাই দেশে একদিনে সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন রোগী শনাক্ত হন। আর ৩০ জুন একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। এরপর থেকে সংক্রমণের হার কমতে থাকে। 

তবে গত ১ মার্চ থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত মেলে। ওই দিন মোট ১৩ হাজার ৫৭০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫৮৫ জনের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে, যা শতকরা হারে চার দশমিক ৩১ ভাগ। ৭ মার্চ ১৪ হাজার ৯২টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬০৬ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। শতকরা হিসাবে এই হার চার দশমিক তিন। 

সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ হাজার ৯৫৮টি নমুনা পরীক্ষা করে ৮৪৫ জন করোনাভাইরাস রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। শতকরা এই হার প্রায় পাঁচ।

“বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ব্যবস্থাপনা খারাপ হয়নি বলা যায়। জুন-জুলাই মাসে সংক্রমণের হার শতকরা ২৫ ভাগের বেশি হয়। আগস্ট থেকে ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে,” বেনারকে বলেন আইইডিসিআর–এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন। 

পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে তাড়াতাড়ি টিকা দেয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু আমাদের জনসংখ্যার মাত্র তিন ভাগ মানুষ গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করেছেন। সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে।”

টিকা দিলে আর করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে না, মানুষের মধ্যে এমন একটি ভুল ধারণা রয়েছে জানিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, “টিকা নেয়ার পরও সংক্রমিত হতে পারেন।”

“আসলে টিকা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে না, মৃত্যু হার কমবে,” বলেন তিনি।

“টিকা নেয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং মাস্ক ব্যবহার করতে হবে,” বলেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। 

‘লক্ষ্য প্রতিটি মানুষকে টিকা দেয়া’

সরকার ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে আনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রা জেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া শুরু করেছে। 

সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে ৪০ লাখের বেশি মানুষ এই টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানায় সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস। 

সরকারি ঘোষণামতে প্রত্যেক গ্রহীতা প্রথম ডোজ নেবার আট সপ্তাহ পরে এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেবেন। 

স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বা এই ধরনের সম্মুখসারির পেশাজীবীদের বাইরে এখন পর্যন্ত ৪০ বছরের বেশি বয়স্করা এই টিকা নেবার সুযোগ পাচ্ছেন। 

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এর মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যা জেনেকার টিকা কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। 

এছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দেওয়া আরো ২০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসেছে।

এই ৯০ লাখ টিকা নিয়েই বর্তমানে দেশের টিকাদান কর্মসূচি চলছে বলে সোমবার বেনারকে জানান স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান। 

তিনি বলেন, “জাতিসংঘের মাধ্যমে কোভ্যাক্স থেকে ৬৮ মিলিয়ন টিকা আমরা পাব। এগুলোর প্রথম চালান জুন মাসের মধ্যে দেশে আসা শুরু হবে।” 

এর বাইরে সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে আরও চার কোটি ডোজ টিকা কেনা হচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্য সচিব বলেন, “আমাদের লক্ষ্য পর্যায়ক্রমে প্রতিটি মানুষকে টিকা দেয়া।” 

এদিকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দৌজার মতে, ঘনবসতিপূর্ণ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ “নেই বললেই চলে।” 

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এপর্যন্ত ৩১ হাজার ৫৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪১৫টি করোনাভাইরাস চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রোগে এখন পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন বলে জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ কোটি ৭০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৫ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।