করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকিতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির

শরীফ খিয়াম
2020.03.19
ঢাকা
20031_Covid_Rohingya_620.jpg টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যকর্মীরা। ১৮ মার্চ ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী অধ্যুষিত জনপদ কক্সবাজারে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। গাদাগাদি করে থাকা সেখানকার দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছেন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দা চিলড্রেনের ওয়েবসাইটে বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মো. মাহফুজ হোসেন বেনারকে বলেন, “যেহেতু করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে আর শরণার্থী শিবিরগুলোও ঘনবসতিপূর্ণ, তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে শঙ্কিত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।”

তবে এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি জানিয়ে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, কোনো রোহিঙ্গার মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা গেলে তাঁর রক্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তাঁরা।

রোহিঙ্গাদের কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁদের আলাদা করে রাখার জন্য শরণার্থীশিবিরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় ইতিমধ্যে ৪৭টি এবং রামু ও চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক শ শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন।

শরণার্থী শিবিরে ‘আইসোলেশান ইউনিট’ (বিচ্ছিন্নকরণ কেন্দ্র) হিসাবে আরও দেড়’শ শয্যা প্রস্তুতের কাজ চলছে বলে জানান শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মাহবুব আলম তালুকদার।

“যদিও শিবিরগুলোয় এখনো কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কোনো সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া যায়নি, তবুও এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইউএনএইচসিআর,” বেনারকে বলেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র লুইস ডোনোভান।

তিনি জানান, বর্তমানে শিবিরগুলোতে ৩২টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ১২৯টি হেলথ পোস্ট (স্বাস্থ্য টোল) রয়েছে।

সিভিল সার্জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলায় এখনো কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি।

সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মোট রোগী ১৭ জন, মারা গেছেন একজন।

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৪০ হাজার ১১৯ জন। আর মারা গেছেন নয় হাজার ৮১৯ জন।

নিষিদ্ধ বিদেশি পরিদর্শক

সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশিদের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আরআরআরসি। সহায়তাকারীদের জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “নতুন করে আসা বিদেশিদের ক্যাম্পে প্রবেশ একদম বন্ধ করা রয়েছে।”

আগে থেকেই কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে যারা চিকিৎসা বা খাদ্যের মতো অতি-জরুরি মানবিক কাজে যুক্ত, বর্তমানে শুধু তাঁরাই শরণার্থী শিবিরে যাচ্ছেন বলে জানান সৈকত।

শরণার্থী শিবিরগুলোর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান আরআরআরসি।

“জনসমাগম এড়াতে রোহিঙ্গাদের মসজিদের বদলে ঘরে বসে নামাজ আদায় করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো বর্মিজ ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করে বিলি করা হচ্ছে।

“নিয়মিত হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে বলা হয়েছে আমাদের,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম।

যেসব চিকিৎসক, নার্স, স্বেচ্ছাসেবক করোনায় আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা দেবেন তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারসোনাল প্রোটেকশান ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও ইউএনএইচসিআরকে জানানো হয়েছে বলেও জানান সিভিল সার্জন।

আতঙ্কে রোহিঙ্গারা

জনঘনত্বের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত নয় বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মাহফুজ হোসেন। তিনি বেনারকে বলেন, “সেখানে বাইরে থেকে আসা সবার অনুপ্রবেশ বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

“অনেক ছোট একটা জায়গায় বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করছেন। যে কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে আমি খুব ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি,” সহমত প্রকাশ করেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী।

এদিকে “অনেক বিদেশ ফেরত রোহিঙ্গাকে নজরদারির আওতায় না আনার কারণে শিবিরগুলোতে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে,” বলে জানান শরণার্থীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা সৈয়দ উল্লাহ।

“বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়ার খবরে রোহিঙ্গাদের ভয় বেড়েছে,” উল্লেখ করে সৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “কীভাবে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায় সেটি অনেকেই জানে না।”

অন্যদিকে টেকনাফের হ্নীলা ইউপি পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের সঙ্গে করোনাভাইরাসের জন্মস্থান চীনের সীমান্ত রয়েছে, আর রোহিঙ্গারা চোরাপথে মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করে। সেজন্য আমাদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি।”

তবে কক্সবাজারে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাসুদুর রহমান মোল্লার মতে, শুধু রোহিঙ্গাদের অবস্থান নয়, পর্যটন ও সীমান্ত জেলা হওয়ার কারণেও ঝুঁকিতে আছে কক্সবাজার।

তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে কক্সবাজারে পর্যটকদের ভ্রমণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।”

এদিকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রোহিঙ্গা শিবির এলাকার মোবাইল ও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস।

গত সোমবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মেথু স্মিথ বলেন, “তথ্য প্রবাহে প্রবেশের সুযোগ রোহিঙ্গাদের জন্য শুধু একটি অধিকার নয়, বরং সার্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্যও এটি অত্যাবশ্যকীয়।”

প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বেরের শুরুতে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সীমিত করে সরকার।

সীমান্তে অরক্ষিত করিডোর

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর ও শাহপরীর দ্বীপ করিডোর দিয়ে পণ্য ও পশু আমদানি-রফতানি অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে আসা মাঝি-মাল্লাদের পরীক্ষা করা হলেও শাহপরীর দ্বীপ করিডোরে কোনো মেডিকেল টিম কাজ করছে না।

“গত ২৯ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ট্রলারে করে পণ্য নিয়ে আসা ২২০ জন মিয়ানমার নাগরিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলেও কাউকে সন্দেহজনক রোগী হিসাবে শনাক্ত করা হয়নি,” বেনারকে বলেন স্থলবন্দরে মেডিকেল টিমের চিকিৎসক ডা. শুভ্র দেব।

“জনবল সংকটের কারণে শাহরীর দ্বীপ করিডোরে এখনো মেডিকেল টিম পাঠানো যায়নি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে ব্যবস্থায় আমরা করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, এতে নিজেরাও ঝুঁকিতে রয়েছি।”

এদিকে মিয়ানমার থেকে আসা মাঝি-মাল্লাদের অবাধে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান টেকনাফ স্থল বন্দরে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন চৌধুরী।

শাহপরীর দ্বীপ করিডোর দিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ছোট-বড় আটটি ট্রলারে কমপক্ষে সাত শ গরু-মহিষ এসেছে বলে বেনারকে জানান স্থানীয় গবাদি পশু আমদানীকারকদের নেতা আবদুল্লাহ মনির।

“ওই মাঝিমাল্লাদের তীরে উঠতে দেওয়া হয়নি। তাঁরা গবাদিপশু নামিয়ে দেওয়ার পরপরই ফিরে গেছেন,” বেনারকে বলেন মনির।

মালয়েশিয়ার সব রোহিঙ্গাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবি

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মালয়েশিয়ায় এক তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারীসহ দেশটিতে বসবাসকারী সব রোহিঙ্গা যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার সুযোগ পান, তা নিয়ে মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

কর্তৃপক্ষের হিসেবে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মালয়েশিয়াতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৯০০ জনের মধ্যে ৫৭৯ জনই ওই তবলিগ জামাত সম্মেলনের সাথে যুক্ত।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর জানায়, নিবন্ধিত কিংবা নিবন্ধনবিহীন যারা এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন, তাঁদের কাউকেই আটক বা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়েরের ঘটনা ঘটেনি।

“ধর্মীয় ওই সমাবেশে অংশগ্রহণ করা বা না করা, সকল শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যদি কারো কোভিড-১৯ এর উপসর্গ দেখা দেয়, তবে তাঁদেরকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়েছে,” বিবৃতিতে জানায় ইউএনএইচসিআর।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য স্বাস্থ্যপরীক্ষায় আসা কারো যদি দেশটিতে বসবাসের বৈধ কাগজপত্র নাও থাকে, তবে তাঁদেরকে যাতে আটক করা না হয় তার জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া ও আবদুর রহমান এবং কুয়ালালামপুর থেকে নিশা ডেভিড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।