করোনাভাইরাস: জনসমাগম নিষিদ্ধ হলেও নির্বাচন হচ্ছে, অফিস–আদালতও খোলা

পুলক ঘটক
2020.03.20
ঢাকা
200320_Corona_story_1000.jpg করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে জনসমাগম এড়ানোর সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বাড়ি যাবার টিকিট কাটতে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়। ২০ মার্চ ২০২০।
[বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম বন্ধ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের পরামর্শ উপেক্ষা করেই শনিবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের তিনটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও অফিস–আদালত চলছে।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই নির্বাচনে ভোট দেবেন বলে তাঁর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের বরাত দিয়ে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানায় সরকারি বার্তাসংস্থা বিএসএস।

“প্রধানমন্ত্রী কাল সকাল ৯টার দিকে ধানমিন্ড সিটি কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেবেন,” জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব।

শনিবার ঢাকা-১০, বাগেরহাট-৪ ও গাইবান্ধা-৩ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনটি আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা দশ লাখের বেশি।

গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক শেষে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, প্রার্থীদের চাওয়া এবং অপচয় রোধ করতে এই নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে সাংবাদিকদের জানান।

বর্তমান পরস্থিতিতে ইসি খুব একটা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রতিটি বুথে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা থাকবে। ভোটাররা ভোট দেওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নেবেন।”

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এমএইচ চৌধুরী লেলিন বেনারকে বলেন, “করোনা সংক্রমণ রোধের জন্য সরকার জনসমাগম নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে। কিছু জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশন বিপুল আয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচন পরিচালনা করছে। রাজনৈতিক সমাবেশ করতে দিচ্ছে। এসব দেখে আমরা বিস্মিত হচ্ছি।”

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাবেশ, বিনোদনের জন্য সমাবেশ কিছুই বন্ধ হয়নি। ফলে দেশব্যাপী করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা আছে।”

এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে উপনির্বাচন স্থগিত ও সামায়িক সময়ের জন্য আদালতের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানান দলটির মহাসচিব মির্জা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ ঠিক রাখার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে অফিস-আদালত বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

সরকারের অবহেলার অভিযোগ

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের অবহেলার অভিযোগ তুলছনে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্রস্তুতির ঘাটতি, অবহেলা এবং সময়ক্ষেপণ নিয়েও রয়েছে সমালোচনা।

“পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ এবং সরকারের নিজস্ব রূপরেখা বাস্তবায়নে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটছে। ফলে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে পড়েছে,” বেনারকে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা: নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “বিদেশ ফেরত সংক্রমণ ঝুকিযুক্ত ব্যক্তিদের সরকারি তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টাইনে না রেখে প্রত্যেককে বাসায় নিজ ব্যবস্থাপনায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলাটা সঠিক হয়নি।”

ডা. লেলিন বলেন, “প্রস্তুতি গ্রহণে তিন মাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অহেতুক বিলম্ব এবং অবহেলার কারণে পরিস্থিতি জটিল হতে চলেছে।”

শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, “মুজিববর্ষ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় করোনাভাইরাসের দিকে সরকার নজর দিতে পারেনি। এই অবহেলা মেনে নেওয়া যায় না।”

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বেনারকে জানান, “সরকারি ব্যবস্থাপনায় বড় আকারের একাধিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আছে। বড় সমস্যা দেখা দেওয়ার আগেই আরও অনেক কিছু আমাদের হাতে চলে আসবে।”

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২০ জনে।

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে গত ৮ মার্চ। এরপর দিনে দিনে এ ভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়​ছে। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন একজন।

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪১৯ জন। আর মারা গেছেন ১১ হাজার ২৭৭ জন।

 

 

অচল হোম কোয়ারেন্টাইন

করোনা সংক্রমিত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিলেও খুব কম সংখ্যক মানুষ তা মেনে চলছেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত দেশে আক্রান্তদের সবাই বিদেশ থেকে আসা অথবা তাঁদের মাধ্যমে সংক্রমিত আত্মীয়-স্বজন।

ইমিগ্রেশন বিভাগের দেয়া তথ্য উল্লেখ করে পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বেনারকে বলেছেন, গত ১ মার্চ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলায় বিদেশ থেকে ফিরেছেন প্রায় ৯০০ প্রবাসী।

তাঁদের মধ্যে মাত্র ৯ জনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার তথ্য থাকলেও অন্যরা কোথায় কী অবস্থায় আছেন তার তথ্য দিতে পারেনি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।

জানতে চাইলে পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. ফজলুর রহমান বেনারকে বলেন, “বিদেশ ফেরতদের শনাক্ত করার জন্য জেলা প্রাশাসনের নির্দেশে প্রতি ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

নাটোরে সম্প্রতি বিদেশ ফেরত ১২শ’ মানুষের মধ্যে ২৭ জন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন এবং ১৪ দিনের মেয়াদ শেষে দুজন মুক্ত হয়েছেন বলে বেনারকে জানান জেলার সিভিল সার্জন মিজানুর রহমান।

“বাকি মানুষের হদিস নেই। অনেকেই এলাকায় ফিরলেও হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার বদলে গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ তাদের খুঁজছে,” বলেন মিজানুর।

এদিকে সুনামগঞ্জের ছাতকে গত ১৫ দিনে দেশে ফেরা ৫৫৪ জন প্রবাসীর মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত মাত্র চারজনকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজীব চক্রবর্তী।

স্বাস্থ্য অধিপ্তদেরর সূত্র মতে, দেশে গত ২১ জানুয়ারি থেকে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন মোট ৯ হাজার ১৩ জন।

স্বাস্থ্যকর্মীদের শঙ্কা

ডাক্তার এবং নার্সদের জন্য হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, গাউন ইত্যাদি ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় মেডিকেলগুলোতে সাধারণ ঠাণ্ডা জ্বর এবং সর্দিকাশির চিকিৎসা দিতেও ভয় পাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিজেদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে বৃহস্পতিবার পাঁচ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন।

ওই মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান বেনারকে বলেছেন, “হাঁচি-কাশিসহ সব ধরনের সংক্রমণ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ঢুকছেন। অথচ চিকিৎসকদের জন্য নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।”

রোগীর সংস্পর্শে যাওয়াতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক কোয়ারান্টিনে আছেন। একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীর সংস্পর্শে আসায় এক চিকিৎসক এবং একজন নার্সকে আইসোলেশনে এবং অন্তত ১৫ জনকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।

“এসব রোগীদের থেকে চিকিৎসকসহ আরও কতজন সংক্রামিত হয়েছেন সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না,” বেনারকে বলেন ডা. লেলিন।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিধানের জন্য ১০ হাজার পারসোনাল প্রটেকশন ইকুয়িপমেন্ট (পিপিই) পাওয়া গেছে। অল্পসময়ের মধ্যে ১০ লাখ পিপিই সংগ্রহ করা হবে বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।