করোনাভাইরাস: বাংলাদেশের ট্যানারি কারখানা অচল, রপ্তানি বন্ধ

জেসমিন পাপড়ি
2020.03.23
ঢাকা
200323_Coronavirus_Taanery_1000.JPG প্রায় দুমাস ধরে রপ্তানি বন্ধ থাকায় সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কারখানাগুলোতে জমেছে চামড়ার স্তূপ। অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মীরা। ১৮ মার্চ ২০২০।
[নিউজরুম ফটো]

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে। প্রায় দুই মাস ধরে রপ্তানি বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে খুঁড়িয়ে চলা এই শিল্প।

নতুন অর্ডার তো আসছেই না, উল্টো বাতিল হচ্ছে একের পর এক পুরোনো অর্ডার। এমন পরিস্থিতে প্রায় প্রতিটি ট্যানারিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের স্তূপ জমেছে।

চলমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল আমদানি করতে না পারায় চামড়া পচে নষ্টও হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাজার কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছেন তাঁরা। এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমাদের সব ধরনের এক্সপোর্ট বন্ধ। নতুন কোনো অর্ডার নেই। পুরোনো অর্ডারও বাতিল হচ্ছে। আর অর্ডার না থাকায় ট্যানারি শিল্প এলাকায় যে ১২৩টি কারখানা চালু ছিল তার সব কটির উৎপাদন বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের কাছে যে অর্ডারগুলো ছিল, বিশেষ করে চীনের অর্ডারগুলো ফেব্রুয়ারিতে শিপমেন্ট করার কথা ছিল। কিন্তু সেসব পণ্য শিপমেন্ট করতে পারিনি। চীনারা তো আসতেও পারছে না। যোগাযোগও করতে পারছে না। নতুন অর্ডারও আসছে না। ফলে শুধু চীনেই তিন থেকে চারশ কোটি টাকার পণ্য আটকে আছে।”

“চীনের বাইরে ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়াই ছিল আমাদের অন্যতম দুটি বাজার। এসব বাজারেও পণ্য রপ্তানি বন্ধ। কোনো অর্ডারও আসছে না। জুলাই-আগস্টে যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল, তা এখনো রপ্তানি হয়নি। এদিকে নতুন মৌসুম চলে আসছে,” বলেন তিনি।

ভবিষ্যৎ শঙ্কার কথা জানিয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, “ব্যবসার অবস্থা আগেও ভালো ছিল না। এদিকে ব্যাংকিং চার্জ বাড়ছে। সেটা দিতে না পারলে অটোমেটিক ক্লাসিফায়েড হব।”

এই চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক সুদ মওকুফ করা দরকার। যে এলসিগুলো ওপেন করা আছে সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া আর্থিক প্রণোদনা না দিলে তো এই শিল্প দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।

শাহীন আহমেদ জানান, গত অর্থ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। যার মধ্যে শুধু চামড়া রপ্তানি করেছে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের।

‘মান বাড়াতে হবে’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু চামড়া শিল্প নয়, করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন। তবে আগে থেকে লোকসানে থাকা চামড়া শিল্প একটু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি ট্যানারি শিল্পকে নানা সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ তাঁদের। তবে টিকে থাকতে হলে পণ্যের মানের পাশাপাশি বাজার সম্প্রসারণের পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা।

“করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামড়া এবং চামড়াজাত শিল্প,” মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বেনারকে বলেন, “সরকার অন্যান্য খাতের ক্ষেত্রে যেসব ব্যবস্থা নেবে চামড়া খাতেও সেসব নেবেন আশা করি।”

তিনি বলেন, “চামড়া ব্যবসায়ীদের এলসির পেমেন্ট কয়েক মাস ধরে দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা ছোট ব্যবসায়ী তাঁরা অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। তাঁদের জন্য স্বল্প সুদে, নমনীয় হারে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।”

তবে ড. ফাহমিদার মতে, “চামড়া ব্যবসায়ীরা যদি লাভজনকভাবে পণ্য রপ্তানি করতে না পারেন, তাহলে প্রণোদনা দিয়েও লাভ হবে না। বিভিন্নভাবে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বে অনেক বেশি। অথচ আমরা রপ্তানি করতে পারছি না।”

তিনি বলেন, “প্রথমে চামড়ার মান বাড়াতে হবে। পণ্যগুলোর চাহিদা তৈরি করে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। বাজার সৃষ্টি করতে না পারলে লাভ নেই।”

অবশ্য শাহীন আহমেদ বলছিলেন, আমাদের চামড়ার মানে কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ব এখন চামড়ার চেয়ে আর্টিফিশিয়াল লেদারের দিকে ঝুঁকছে- এটা একটা অন্যতম কারণ।”

এ প্রসঙ্গে শিল্প সচিব মো. হালিম বেনারকে বলেন, “চামড়া শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমরা অবগত। সরকার তাঁদের বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। চামড়া ব্যবসায়ীদের অতীতের নেওয়া ঋণগুলোর সুদ আরও কয়েক বছর ব্লক করে রাখা বা যাতে তা না বাড়ে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন ব্যাংকিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে অনুরোধ করা হবে।”

“পাশাপাশি আগামী মৌসুমের চামড়া ক্রয়ে যাতে তাঁদের জন্য ঋণ বরাদ্দ থাকে সে বিষয়েও সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছে। প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুবিধা যেসব তাঁরা পেয়ে থাকেন তা চলমান থাকবে,” বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, চামড়া শিল্পকে পরিবেশসম্মত ও বিশ্বমানের পর্যায়ের নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ঢাকার অদূরে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ট্যানারি শিল্পের কার্যক্রম শুরু হলেও সেন্ট্রাল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পরিপূর্ণভাবে চালু হয়নি। যে কারণে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

জানা যায়, বর্তমানে বিটিএর সদস্যভুক্ত ১৮৮টি কারখানা কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাভারে ১২৩টি কারখানা চালু হয়েছে। কমপ্লায়েন্স না থাকায় যার বেশির ভাগেরই বৈশ্বিক মান সনদ বা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ নেই। এই সনদের মূল শর্ত হলো কারখানাগুলোর দূষিত বর্জ্যকে পরিবেশের উপযোগী করার জন্য এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন।

এ বিষয়ে শিল্প সচিব বলছিলেন, “ট্যানারি শিল্প এলাকাতে অনেক কারখানাই এখনো কমপ্লায়েন্ট হয়নি। এখন কাজের চাপ কম। তাই লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পেতে যা করণীয় তা এই সময়ে করার আহ্বান জানিয়েছি।”

তবে শাহীন আহমেদ বলেন, “কমপ্লায়েন্সের জন্য ইনভেস্ট করা এই সময়ে সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের টাকা আটকে আছে। এই মুহূর্তে ব্যয় করা কীভাবে সম্ভব?”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।