সরকারি ছুটির প্রথম দিনে ঢাকা কার্যত অবরুদ্ধ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.03.26
ঢাকা
200326_Dhaka_shut_down_1000.jpg রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউর চেকপোস্টে ‘রাইড শেয়ারিং' সেবাদানকারী এক মোটরসাইকেল চালককে বাসার বাইরে বের না হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। ২৬ মার্চ ২০২০।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ঘোষিত ১০ দিনের ছুটির প্রথম দিনেই বৃহস্পতিবার ঢাকা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। সকল গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী।

তবে পণ্য সরবরাহকারী কিছু ট্রাক চলাচল করেছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।

সশস্ত্রবাহিনী ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহলের কারণে সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হননি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “দেশের মানুষ সরকারি সিদ্ধান্তে সাড়া দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে অবস্থান করছেন। আর জনগণের এমন অংশগ্রহণ থাকলে দেশে করোনাভাইরাস বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।”

এদিকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির একদিন পার না হতেই পোশাক কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বিষয়টি স্বস্তিদায়ক হলেও বন্ধের পূর্বে বেতন জুটবে কি না- সেই শঙ্কায় রয়েছেন শ্রমিকরা।

ঢাকা কার্যক নিশ্চুপ

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন অংশে অবস্থান নেন, টহল দিতে থাকেন। সকল ধরনের গণপরিবহন বন্ধ ছিল। সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হননি।

জরুরি প্রয়োজনে চলাচলকারী গাড়ি অথবা মোটরসাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তাঁরা। তবে রাস্তায় দরিদ্র রিকশা চালকদের দেখা গেছে।

সকল অফিস, আদালত, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অধিকাংশ কাঁচাবাজার বন্ধ ছিল। তবে ওষুধ, কিছু খাবার ও মুদি দোকান খোলা ছিল।

ঢাকার বাইরে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক তৎপরতার কারণে সাধারণ মানুষ ঘরেই অবস্থান করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরে সশস্ত্র টহলসহ সরকার ঘোষিত ১০ দিন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না বের হওয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়েছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর জানিয়েছে।

বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে পুলিশসদস্যরা তা বন্ধ করে দেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায় কিছু দোকানিকে দোকান থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। আর কিছু যুবককে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে পিটিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা।

সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, বৃহস্পতিাবর পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২৩ হাজার থেকে বেশি।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন পাঁচজন, আর বৃহস্পতিবার শনাক্ত পাঁচ জনসহ মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪ জন।

তবে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রকৃত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দেশের অনেক অংশেই মানুষ ১০ দিনের ছুটি পেয়ে বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন গণপরিবহন স্টেশনে জড়ো হয়েছেন, গ্রামাঞ্চলে ফিরে গেছেন। সেখান থেকে ভাইরাসটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের হাইওয়ে পুলিশের কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য মো. সালাউদ্দিন বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে জানান, “আজ বৃহস্পতিবার থেকে কোনো গাড়ি ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়নি। তবে বুধবার যেসকল গাড়ি ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোর উদ্দ্যেশে ছেড়ে গেছে সেগুলো তীব্র যানজটে পড়েছে।”

তিনি বলেন, “ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটে গতকাল গাড়ির চাপ ছিল প্রচণ্ড। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০ জন।”

একেকটি গাড়ি চার ঘন্টা পর্যন্ত যানজটে আটকা পড়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে আজ বেলা একটার পর রাস্তা পুরোপুরি ক্লিয়ার হয়ে গেছে।”

এদিকে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও চিকিৎসক আ.ফ.ম. রুহুল হক।

তিনি বেনারকে বলেন, “সরকার ছুটি ঘোষণা করেছে দেশের মানুষদের ঘরে থাকার জন্য। কিন্তু মানুষ সেটা না করে দলে দলে বাস ও রেল স্টেশনে ভিড় করেছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলার অন্যতম কাজ হলো জনসমাগম এড়িয়ে চলা। এভাবে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।”

“আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কত তা সঠিকভাবে বলা কঠিন,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা যদি দক্ষিণ কোরীয়ার মতো মানুষদের ধরে ধরে পরীক্ষা করতে পারতাম তাহলে সংখ্যা যে কত হতো তা বলা সম্ভব নয়। তবে আমরা তা পারব না। আমাদের সেই সক্ষমতা নেই।”

“আইইডিসিআর কিছু টার্গেটেড মানুষদের পরীক্ষা করছে। তাদের সীমিত সম্পদ ও জনবল নিয়ে কাজ করতে হয়,” বলেন রুহুল হক।

পোশাক কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত

অবশেষে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বৃহস্পতিবার এক চিঠিতে সরকারি ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে সকল কারখানা বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান সংগঠনটির সভাপতি রুবানা হক।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় রপ্তানিমুখী খাতের শ্রমিকদের বেতন–ভাতা দিতে সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণার পরদিনই কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল বিজিএমইএ।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও মালিকেরা কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেননি।

সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো বার্তায় বৃহস্পতিবার বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।”

“তবে পিপিই ও মাস্ক তৈরি হচ্ছে এমন কারখানাগুলো খোলা থাকতে পারে,” মন্তব্য করে এসব কারখানায় শ্রমিকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বানও জানান রুবানা হক।

এদিকে বিজিএমইএর এই সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেও শ্রমিকদের বেতন দেয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতারা।

এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বেনারকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে অতিপ্রয়োজনীয় এই সিদ্ধান্ত নিতে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”

“তাছাড়া বিজিএমইএ সভাপতির বার্তায় শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে মাসের শেষ মুহূর্তে বেতন না দিয়ে ছুটি দিলে শ্রমিকেরা আরও বেশি বিপদে পড়বে।”

এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সকল টেক্সটাইল কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন বৃহস্পতিবার এক বার্তায় এ তথ্য জানান।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।