করোনাভাইরাস মোকাবেলার কৌশল নিয়ে সমালোচনাকারীদের গ্রেপ্তার করছে সরকার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
2020.04.01
ঢাকা
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই বাংলাদেশে এই সঙ্কট মোকাবেলার কৌশল নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন, সরকার তাঁদের মত প্রকাশে বাধা দিচ্ছে, এমনকি গ্রেপ্তারও করছে বলে জানিয়েছে মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
বুধবার দেয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটি এই অভিযোগ করে বলেছে, মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে চিকিৎসক, বিরোধীদলের সদস্য ও ছাত্রসহ এক ডজন মানুষকে সরকারের সমালোচনার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
এদিকে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট শুনলেই সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল কোথাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি
সংস্থাটির এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বিবৃতিতে বলেন, “কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হলে তা বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের রয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, যারা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবেন অথবা এই সঙ্কট মোকাবেলার ব্যাপারে সরকারের কৌশল নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন তাঁদের স্তব্ধ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “এই অবস্থায় সরকারের উচিত মানুষের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব না করে বরং এই ভাইরাস প্রতিরোধ, দমন ও এর চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা জানিয়ে জনগণকে আশস্ত করা।”
বিবৃতিতে বলা হয়, গুজব ঠেকাতে গণমাধ্যম তদারকি করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। করোনাভাইরাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘উস্কানিমূলক’ পোস্ট দেয়ায় দুই শিক্ষককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিরোধীদলের সদস্য ডা. ইফতেখার আদনানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আর সরকার তথ্য গোপন করেছে।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “আমরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করি। সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যস্ত। কারো মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।”
তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমাদের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা করোনাভাইরাস নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও গুজব রটানোর জন্য কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা অপরাধ করেছে। অপরাধ করলে যে কোনো দেশের সরকার হোক, তাদের গ্রেপ্তার করবে না?”
মন্ত্রী বলেন, “যারা মিথ্যা তথ্য ও গুজব প্রচার করেছে, তারা যে পেশারই হোক না কেন তারা অপরাধী।”
আতঙ্কিত এলাকা ও হাসপাতাল
করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এসেছে।
গত শনিবার ঢাকার বাসাবো এলাকার বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলমাছ উদ্দিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে একে একে মুগদা হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতালে ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও কেউ তাঁকে ভর্তি করেনি বলে সাংবাদিকদের জানান তাঁর ছেলে আরিফ হাসান।
তাঁর অবস্থার অবণতি হলে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহয়তায় অবশেষে তাঁকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি।
নওগাঁর রানীনগর উপজেলার আল-আমিন নামের এক যুবক শনিবার মস্তিষ্কের মেনেনজাইটিসে আক্রান্ত হন। তবে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকায় রাণীনগর, আদমদিঘী, নওগাঁ সদরসহ পাঁচ হাসপাতালে ঘুরে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি বলে বেনারকে জানান তাঁর বাবা মোখলেছুর রহমান।
অসুস্থ রোগীকে নিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরির পর রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার এক ঘণ্টার মাথায় মারা যান আল-আমিন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মূখপাত্র ডা. আজিজুল হক আজাদ বেনারকে বলেন, “নওগাঁ থেকে আল-আমিন নামে রোগীটি যখন আমাদের হাসপাতালে আসেন তখন তাঁর অবস্থা খুব খারাপ ছিল।”
তিনি বলেন, “আমরা লক্ষণ দেখে বুঝতে পারি তাঁর মস্তিস্কের সংক্রমণ ছিল। সেকারণে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট ছিল। তবে তিনি ভর্তির পর পরই মারা যান।”
ডা. আজাদ বলেন, “আসলে করোনাভাইরাসের কারণে সবার মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে আমরা এখন করোনাভাইরাসের রোগীদেরও ভর্তি নিচ্ছি।”
তিনি বলেন, “দেশের মানুষ এখন সবাই ডাক্তার হয়ে গেছে। কোনো মানুষের জ্বর-শ্বাসকষ্ট হলেই তাঁকে করোনাভাইরাস ভেবে সমাজচ্যুত করছে।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমরা নাটোরের বাগাতিপাড়া থেকে একজন রোগী পেয়েছি, যার শ্বাসকষ্ট ছিল। তিনি আসলে হাঁপানীর রোগী। তাঁর গ্রামের বাড়িতে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে এক পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রতিবেশিদের জানান যে, মাস দেড়েক আগে ঢাকার নীলক্ষেতে এক বিদেশির সাথে তিনি ধাক্কা খেয়েছেন।”
ডা. আজাদ বলেন, “এই কথা শুনে সারা গ্রামের মানুষ তাঁকে ধরে জোর করে রাজশাহীগামী ট্রাকে তুলে দেয়।”
সর্দিকাশি ও জ্বরের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে গত ১৯ মার্চ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্নির ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করেন। তাঁরা করোনাভাইরাস সন্দেহে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখেন।
ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. ছিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “আসলে সত্য কথা বলতে কি, করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে দেশের মানুষ ও ডাক্তারদের একাংশ প্রচণ্ড শঙ্কার মধ্যে আছেন। জ্বর, শ্বাসকষ্ট দেখলেই তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অনেকেই এধরনের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে আনাগ্রহ দেখান। কিন্তু জ্বর, শ্বাসকষ্ট হলেই তো আর করোনাভাইরাসের রোগী হলো না।”
প্রয়োজন বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নতুন এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূখপাত্র ডা. হাবিবুর রহমান। এ নিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ছয়, আর মোট রোগীর সংখ্যা ৫৪।
তিনি জানান, সরকারের রোগতত্ব বিভাগ এপর্যন্ত ১,৭৫৯ জন রোগীর রক্ত পরীক্ষা করেছে। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারের উচিত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বাংলাদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে আরও বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হক বেনারকে বলেন, “আমাদের ১৬ কোটির বেশি মানুষ। সেখানে দিনে ১৪০/১৫০টি নমুনা পরীক্ষা করা সঠিক নয়।”
তবে “আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী নমুনা সংগ্রহ করি,” মন্তব্য করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর পরিচালক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বেনারকে বলেন, “আমাদের সাথে যারা যোগাযোগ করেন তাঁদের সাথে কথা বলে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, কোন কোন রোগীর রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।”
“সবার রক্ত নমুনা গ্রহণের দরকার নেই,” বলেন ডা. ফ্লোরা।
প্রসঙ্গত, গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, বুধবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ ২৬ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৪৬ হাজারের বেশি।
দিল্লিতে বাংলাদেশি আক্রান্ত
মার্চের মাঝামাঝি ভারতের দিল্লিতে তবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
“আমরা যতটুকু জেনেছি দিল্লিতে কিছু বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তাঁদের সংখ্যার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই,” বুধবার বেনারকে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মার্চের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত দিল্লির একটি মসজিদে ওই তবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারী অন্তত ২৪ জন করোনাভাইরাসের রোগী বলে শনাক্ত হয়েছেন, মারা গেছেন অন্তত সাত জন। এছাড়া আরো প্রায় ৫০০ জনকে রাখা হয়েছে পর্যবেক্ষণে।
দিল্লি পুলিশের তথ্যমতে, সমাবেশে অংশগ্রহণকারী প্রায় দুই হাজার মানুষের মধ্যে বাংলাদেশিসহ বিদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০ জন।
তবে যারা মারা গেছেন তাঁদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি আছেন কি না তা এখনো জানা যায়নি বলে জানান আব্দুল মোমেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে দ্রুত ছড়ানোর আশঙ্কা
অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দ্রততায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি)।
পানি প্রবাহের স্থান প্রশস্তকরণ, আইসোলেশনের স্থান চিহ্নিতকরণ ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য বসবাসের স্থানগুলোকে পুননির্মাণ বা নতুন আবাসস্থল নির্মাণ করে এই ঝুঁকি কমানো যেতে পারে বলে জানায় আইআরসি।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪০ হাজার শরণার্থী বসবাস করেন বলেও জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।