রোহিঙ্গা শিবির থেকে ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন ৫০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার

সুনীল বড়ুয়া ও শরীফ খিয়াম
2020.04.02
কক্সবাজার ও ঢাকা
200402_BD_COVID_1000.jpg উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী শিবির। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে এখন জনসমাগম অনেকটা কম। ৩০ মার্চ ২০২০। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলার কাজ সহজ ও নিরাপদ করতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির এলাকাগুলো থেকে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট বব্যহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বৃহস্পতিবার সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে ৫০টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে লেখা ওই যৌথ আবেদনে হিউমেন রাইটস ওয়াচ, আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অর্ধশত সংগঠন জানায়, করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমণ প্রতিরোধ করে শরণার্থী, সেবাকর্মী এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনক্ষার্থে মোবাইল ও ইন্টারনেট মাধ্যমে অবাধ প্রবেশাধিকার খুবই জরুরি।

এতে বলা হয়, “চলমান মহামারির সময় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার শুধু স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুততার সাথে নির্ভরযোগ্য ও হালনাগাদ নিদের্শনা আদান-প্রদানেই সহায়তা করবে না, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেও সহায়তা করবে।”

মোবাইল ফোন ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনামতো কারো করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য রোগতত্ত্ব বিভাগের হটলাইনে যোগাযোগ করাও সম্ভব না বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।

বিবৃতিতে বলা হয়, “মোবাইল বা ইন্টারনেট সুবিধা না থাকলে স্বাস্থ্যকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের জরুরি তথ্য আদান-প্রদানের জন্য বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর নির্ভর করতে হবে, যা তাঁদের কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে, এবং সেবাপ্রদানের গতি শ্লথ করে দেবে।”

একই সাথে রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ বন্ধ করার আহ্বানও জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।

প্রসঙ্গত, নিরাপত্তার অজুহাতে গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। এছাড়া রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয় জনগণের মধ্যে মিশে যেতে না পারে সেজন্য গত নভেম্বর থেকে শরণার্থী শিবিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু করা হয়।

গুজবের কবলে রোহিঙ্গা শিবির

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবের কারণে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে সেবাসংস্থাগুলো।

জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং মানবিক বিশ্লেষণকারী প্রকল্প এসিএপিএস এর একাধিক নথিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রোহিঙ্গা নেতারাও।

এ প্রসঙ্গে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূর বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই খুব ভয়ে আছেন। কোনো ঝুঁকিপূর্ণ সঙ্কট আসলেই এখানে গুজবের মাত্রা বেড়ে যায়।”

“ক্যাম্পের বেশিরভাগ লোক অশিক্ষিত। যে কারণে গুজব ছড়ায় বেশি, আবার গুজবে আতঙ্কও ছড়ায়,” বলেন রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ছৈয়দ উল্লাহ।

তবে বর্তমানে “ক্যাম্পগুলোতে করোনা সচেতনতা অনেকটা বেড়েছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝিরা (নেতা) সাধারণ রোহিঙ্গাদের গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।”

সরকারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসু দ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “শুরু থেকেই ‘রিউমার ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে ক্যাম্পগুলোতে কাজ করছি আমরা। করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি গুজবের বিষয়েও সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে।”

‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে উড়ো খবর’ শিরোনামে প্রকাশিত নথিতে আইওএম এবং এসিএপিএস রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে বেশ কিছু গুজবের কথা উল্লেখ করেছে।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের ধারণার কথা জানতে গিয়ে আইওএম ও এসিএপিএস দেখেছে, শিবিরগুলোয় এই ভাইরাসটির খবর দ্রুত ছড়ালেও সেখানে এ সম্পর্কিত ধারণায় স্পষ্টতার অভাব রয়েছে।

কীভাবে ভাইরাসটির পরীক্ষা বা চিকিৎসা করা উচিত সে সম্পর্কে কোনো সচেতনতা তাঁদের নেই।

কক্সবাজারে মানবিক সহায়তায় সক্রিয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে অসচেতন মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই ক্যাম্পগুলোতে গুজবের প্রভাবও একটু বেশিই।”

সৈকত বলেন, “বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে গুজবসহ সামগ্রিক বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে দুই হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। সংক্রমণ রোধের যে স্বাস্থ্যবিধি তা মেনেই তারা রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রচারপত্র বিলি করছেন বা ভিডিও ক্লিপ দেখাচ্ছেন।”

“তাছাড়া প্রতিটি ক্যাম্পে তথ্যকেন্দ্র আছে। সেখান থেকেও বিভিন্ন তথ্য রোহিঙ্গাদের জানানো হচ্ছে,” বলেন তিনি।

অন্য যেকোনো সূত্রের চেয়ে মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় নেতাদের দেওয়া তথ্যকে রোহিঙ্গারা বেশি বিশ্বাস করেন বলেও জানায় আইওএম ও এসিএপিএস।

সংগঠনগুলোর মতে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধমূলক কোনো বার্তা বা কর্মসূচি যদি রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় চর্চার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে রোহিঙ্গারা তা নাও মানতে পারেন।

এই পরিস্থিতি মোকাবেলোয় করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রচারণায় মসজিদের ইমামদের কাজে লাগানো হচ্ছে বলে বেনারকে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসু দ্দৌজা নয়ন।

“মসজিদের ইমামদের আমরা কাজে লাগাচ্ছি। নামাজের সময় তাঁরা রোহিঙ্গাদের করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন,” বেনারকে বলেন শামসু দ্দৌজা নয়ন।

“শিবিরের মসজিদগুলোয় এখন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ হচ্ছে,” জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নূর বলেন, “নামাজের সময় ইমামরা করোনা সম্পর্কে সর্তক করছেন। লোকজনকে সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়ার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার ও নিয়মিত নামাজ পড়ার পরামর্শও দিচ্ছেন।”

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ লাখ দুই হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ৫১ হাজার।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ছয়জন। আর বৃহস্পতিবার শনাক্ত দুই জনসহ মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬ জন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।