করোনাভাইরাস: ঢাকার অর্ধশতাধিক এলাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ ও কক্সবাজার জেলা অবরুদ্ধ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.04.08
ঢাকা
200408_COVID-19-Bangla_1000.JPG করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় জনসাধারণের চলাচল রুখতে সাইন বোর্ড এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে পাহারা দিচ্ছেন সেনাসদস্যরা। ৮ এপ্রিল ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিনই আগের চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে ঢাকায়। প্রতিদিন লকডাউন করা হচ্ছে রাজধানীর নতুন নতুন এলাকা। পুলিশের হিসেবে, এমন এলাকার সংখ্যা এখন অর্ধশতাধিক।

সরকারের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার পরেই করোনাভাইরাসের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস—এমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে বুধবার লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়েছে ওই জেলা। সেখানকার জেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই কোয়ারেনটিনে আছেন।

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বন্দরনগর নারায়ণগঞ্জ থেকে তাবলীগ জামাতের একটি দল কক্সবাজারে প্রবেশ করেছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বুধবার লকডাউন করা হয়েছে পর্যটন জেলা কক্সবাজার।

নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সেলিম রেজা বেনারকে জানান, “করোনাভাইরাস আক্রান্তের দিক থেকে ঢাকার পরেই স্থান নারায়ণগঞ্জের। জেলায় এখন পর্যন্ত ৩৭ জন নিশ্চিত করোনাভাইরাস রোগী মিলেছে। মারা গেছেন ছয়জন।”

তিনি বলেন, জেলার ২০ লাখ মানুষের মধ্যে একটি বড় অংশ সারা দেশ থেকে আসা শ্রমিক। তাঁরা জেলার বিভিন্ন শিল্প কারাখানায় কাজ করেন। সরকার ছুটি ঘোষণা করার পর এসব শ্রমিক সারাদেশে ছড়িয়ে গেছেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।

সেলিম রেজা বলেন, “নারায়ণগঞ্জ থেকে করোনাভাইরাস দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে আমরা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও সদর উপজেলা লকডাউন করেছি। এখন থেকে কেউ নারায়ণগঞ্জ থেকে বের হতে পারবেন না, অথবা প্রবেশ করতে পারবেন না। এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ টহল দিচ্ছে।”

তিনি বলেন, এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাবলীগ জামাতের একটি দল কক্সবাজার পৌঁছেছেন।

সেলিম রেজা বলেন, “আমরা জানি না তারা করোনাভাইরাস বহন করছেন কি না। কিন্তু তাঁদের কেউ করোনাভাইরাস বহন করতে পারেন—এমন সম্ভাবনা আছে। সেকারণে আমরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করেছি।”

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বেনারকে বলেন, “নারায়ণগঞ্জ থেকে তাবলীগ জামাতের দল কক্সবাজার এসেছেন জানতে পেরে আমরা তাঁদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। পুলিশও কাজ করছে। খুঁজে বের করতে পারলে আমরা তাঁদের সঙ্গনিরোধ করে রাখব।”

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ অবস্থা সন্তোষজনক। ২৩ লাখ স্থানীয় মানুষের মধ্যে মাত্র একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে এখন পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হননি।

কামাল হোসেন বলেন, “তবে আমরা ঝুঁকির মধ্যে আছি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে। আমরা রোহিঙ্গা শিবিরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সেখানে কর্মরতদের মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ কর্মীদের শিবিরে প্রবেশ করতে দিচ্ছি।”

ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের মূখপাত্র মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা শহরের যেখানেই করোনাভাইরাস রোগী মিলছে সেই অঞ্চল লকডাউন করা হচ্ছে। সেখান থেকে কাউকে বের হতে অথবা সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ঢাকার টোলারবাগ, উত্তর টোলারবাগ, মিরপুর-১১, মোহাম্মপদপুর, বাসাবোসহ বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো সেখান থেকে যাতে করোনাভাইরাস অন্যত্র ছড়িয়ে না পড়ে।

মাসুদুর রহমান বলেন, “আমরা আশঙ্কা করছি ভবিষ্যতে ঢাকার লকডাউন এলাকা সম্প্রসারিত হবে।”

নতুন আক্রান্ত ৫৪, মৃত্যু ৩

গত ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ জন আর মারা গেছেন তিনজন। আক্রান্তদের মধ্যে ৩৯ জন ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছেন।

বুধবার করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ।

তিনি বলেন, সব মিলিয়ে দেশে এখন মোট কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২১৮ জনে। আর গত ৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ জনে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৯৮১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ৫৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, বুধবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৮৭ হাজারেও বেশি।

কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য চীনা সমর্থন কামনা

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাইরাসটি প্রতিরোধে এবং রোগীদের চিকিৎসার জন্য চীনের সমর্থন চেয়ে মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই–কে ফোন করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

চীনা শহর উহানে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। এরপর সারা বিশ্বে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম আক্রান্ত হলেও চীন সরকার বুধবার উহানকে খুলে দিয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।

করোনাভাইরাস চিকিৎসার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন দেশে মাস্কসহ করোনাভাইরাস চিকিৎসার বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করছে চীন। একইসাথে তারা বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক দল পাঠাচ্ছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিফোন আলাপের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস।

বুধবার সন্ধ্যায় দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে আরও সহায়তা করতে, তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ে এবং একটি বিশেষজ্ঞদল পাঠাতে প্রস্তুত চীন।

তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, গত নভেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর শুরুর দিকে সংকটের কথা গোপন করায় সমালোচনার শিকার হয়ে এখন দেশটি ভাবিমূর্তি উদ্ধারের অংশ হিসেবে আক্রান্ত প্রতিবেশী দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক সংগঠন ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’ মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, “তাদের মারাত্মক ভুলগুলোর একটি হলো উহানে প্রাদুর্ভাব ঘটার শুরুতেই বিষয়টি না জানানো।”

“মহামারি মোকাবেলায় চীনের কঠোরতার বিষয়ে পশ্চিমাদের যে সমালোচনা ছিল, এসব ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে তারও জবাব দিতে চায় দেশটি,” গত মার্চে বেনারকে বলেছেন ফিলিপাইন ইনস্টিটিউট ফর পিস, ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেরোরিজম রিসার্চ এর প্রধান রোমেল বানলাওইর।

তিনি বলেন, “চীন এখন মহামারির মারাত্মক প্রভাব কাটিয়ে উঠছে। তাই তারা বিশ্বকে বলতে চায় যে, চীন তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে অন্যদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারে।”

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে হাসপাতাল সরঞ্জাম, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা পোশাক, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরীক্ষার কিট এবং চিকিৎসা পরামর্শ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।