করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দেশে উৎসববিহীন নববর্ষ

কামরান রেজা চৌধুরী ও নিশা ডেভিড
2020.04.14
ঢাকা ও কুয়ালালামপুর
200414_Pahel_Boishakh_1000.jpg ঢাকার শাহবাগের যে স্থানে গত বছর পহেলা বৈশাখে ছিল জানাকীর্ণ মঙ্গল শোভাযাত্রা (ডানে) সেই একই স্থান করোনাভাইরাসের কারণে এ বছরের নববর্ষে জনশূন্য। ১৪ এপ্রিল ২০২০ ও ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হয় স্থানীয় নববর্ষ। ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হয় বর্ষবরণের উৎসব। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সবগুলো দেশেই এই বছর নববর্ষ পালিত হচ্ছে উৎসববিহীন।

মঙ্গলবার ১৪ এপ্রিল নতুন বাংলা বছর ১৪২৭'র প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে মাত্র একবার পহেলা বৈশাখের উৎসব হয়নি বাংলাদেশে। দ্বিতীয়বারে মতো উৎসববিহীন পহেলা বৈশাখ পালিত হলো মঙ্গলবার।

একইভাবে উৎসববিহীন গেছে থাইল্যান্ডের নববর্ষ ‘সংক্রান’ ও মালয়েশিয়ায় তামিলদের নববর্ষ ‘পুঠান্দু’, মালয়লামদের নববর্ষ ‘বিষু’ ও শিখদের ‘বৈশাখী’।

বাংলাদেশে ডিজিটাল পহেলা বৈশাখ

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে পালিত হলো বাঙালির সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখ।

বৈশাখের মূল আকর্ষণ রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এ বছর পালিত হয়নি। বের করা হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রাও। তবে ফেসবুকের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেছে ছায়ানট।

সাংস্কৃতিক সংগঠন উদিচীও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে পালন করেছে পহেলা বৈশাখ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগ্রহের ঘাটতি ছিল না সাধারণ মানুষের। বর্ণিল সাজে নাচ-গানের ভিডিও এবং ছবি পোস্ট করতে ভোলেননি তাঁরা। পোস্ট করেছেন পান্তা-ইলিশের ছবি, ভিডিও।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী বেনারকে বলেন, “পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উৎসব। কারণ এটি সকল ধর্মের মানুষের অনুষ্ঠান। আমার মনে আছে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের কারণে আমরা ১৯৭১ সালে পহেলা বৈশাখ পালন করতে পারিনি। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে আমরা সশরীরে এই উৎ​সব পালন করতে পারলাম না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা পালন করতে হলো।”

তিনি বলেন, “বিটিভি, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ছায়ানট, উদিচীসহ বিভিন্ন সংগঠন অনলাইনে পহেলা বৈশাখ পালন করেছে।”

পহেলা বৈশাখের আগের দিন সোমবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু তাহের বেনারকে বলেন, “জনগণ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনলাইনে পহেলা বৈশাখ পালন করেছে। দেশের মানুষের মধ্যে পহেলা বৈশাখ পালনে উৎসাহের কমতি ছিল না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুহুল আলম বেনারকে বলেন, “পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন মুখোশ, অসাম্প্রদায়িক শ্লোগান সংবলিত বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন তৈরি করি। বৈশাখের প্রথম প্রহরকে স্বাগত জানাতে সকল ধর্মের সকল বয়সের মানুষ রমনা বটমূল ও শাহবাগে সমবেত হন। কিন্তু এ বছর কিছু নেই। এটি অবিশ্বাস্য।”

তিনি বলেন, “রমনা পার্কে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে একটু জায়গা পেতে পহেলা বৈশাখের আগের রাত থেকে মানুষ জড়ো হয়। কিন্তু এ বছর কেউ নেই, নেই মঙ্গল শোভাযাত্রাও। অনলাইনে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখতে হলো।”

ছায়ানট প্রধান সানজিদা খাতুন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

ঘরে আবদ্ধ থাকলেও পহেলা বৈশাখ পালনে আগ্রহের কমতি ছিল না সাধারণ মানুষের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়েছে বেশ ধুমধাম করে।

বাংলাদেশে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন, বিনিয়োগ করেন। এ বছর পহেলা বৈশাখ পালিত না হওয়ায় তাঁরা মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

সরকারি তথ্য বিবরণীতে মঙ্গলবার বলা হয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘এসো হে বৈশাখ’ শীর্ষক একটি বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নির্মাণ করে যা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি চ্যানেলে একযোগে সম্প্রচারিত হয়।

অনুষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ ১৪২৭-এর আগমন উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে স্বাস্থ্যকর্মী ও সরকারের নির্দেশনার পরেও অনেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে উন্মুক্ত চলাফেরা করছেন বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

“আমাদের দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। তাই আমাদের সবাইকে ঘরে থাকেতে হবে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটি বড় অংশের মানুষ লকডাউন মানছেন না। ধাক্কাধাকি করে বাজার করছেন। একবার ভেবে দেখছেন না যে এখান থেকে সংক্রমিত হতে পারেন।

“আমাদের ইতিমধ্যে কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটেছে। মানুষ যদি সরকারের ঘরে থাকার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘরে না থাকেন, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটে পড়তে পারি,” বলেন মন্ত্রী।

আবার উঠে দাঁড়াব: মালয়েশিয়া

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জনসমাগম এড়াতে লক ডাউনের কারণে মালয়েশিয়াতেও এই বছর উদযাপিত হয়নি নববর্ষের অনুষ্ঠান। মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী তামিল, মালয়লাম ও শিখ সম্প্রদায়কে তাঁদের নববর্ষে অনলাইনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশটির রাজা।

“আমরা সবার জন্য একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় নতুন বছর কামনা করি। যদিও বর্তমানে সময় খুব কঠিন, তবুও সমষ্টিগতভাবে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠব,” রাজকীয় প্রসাদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে তামিল নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন মালয়েশিয়ার রাজা আল-সুলতান আব্দুল্লাহ রিয়াতউদ্দিন আল-মোস্তফা বিল্লা।

“সমষ্টিগতভাবে আশাবাদ ও সাহস বজায় রাখুন। আমরা অবশ্যই জয়ী হবো,” মন্তব্য করে রাজা বলেন, “ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন।”

এর আগে সোমবার মালয়েশিয়ার রাজা দেশটির শিখ সম্প্রদায়কে ‘বৈখাশী’তে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, “বর্তমানে হয়ত আমরা আমাদের সব প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি, কিন্তু এই মহামারি মোকাবেলায় জাতি হিসেব আমরা একসাথে আছি।”

“পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এবং এক পরিবার, এক জাতি ও একই মালয়েশিয়ান হিসেব আমরা আবার উঠে দাঁড়াব।”
পুঠান্দু বা বারিসা পিরুপপু নামে পরিচিত তামিল নববর্ষ শুরু হয় বছরের প্রথম মাস ‘চিত্তরাই বিষু’র প্রথম দিন থেকে, যা ছিল মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল। একই দিনে পালিত হয় মালয়লামদের নববর্ষ ‘বিষু’ ও শিখদের ‘বৈশাখী’।

“মায়ের হাতে বানানো ঐতিহ্যবাহী মালয়লাম খাবার খেয়েই সাধারণত এই দিনটা আমরা উদযাপন করি। তবে করোনাভাইরাসের কারণে, এই বছর একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবেই আমাদের নববর্ষটা উদযাপন করতে হচ্ছে,” বেনারকে বলেন কুয়ালালামপুরের বাসিন্দা মালয়লাম সম্প্রদায়ের মানুষ আর. সিথিবিনয় (৩৬)।

পানিখেলা বন্ধ থাইল্যান্ডে

করোনভাইরাস মোকাবেলার অংশ হিসেবে থাইল্যান্ডও দেশটির নববর্ষ ‘সংক্রান’ উদযাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। দেশটিতে সাধারণত এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত নববর্ষের উৎসব হয়ে থাকে।

সংক্রানের সবচে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান পানিখেলা। যেখানে উন্মুক্তভাবে একে অন্যের ওপর পানি ছিটিয়ে থাকেন থাইল্যান্ডের মানুষেরা। কিন্তু লক ডাউনের কারণে নববর্ষের পানিখেলা খেলতে পারেননি কেউ।

দেশগুলোর সরকারি হিসেবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা মালয়েশিয়াতে চার হাজার ৯৮৭, থাইল্যান্ডে দুই হাজার ৬১৩ ও বাংলাদেশে এক হাজার ১২ জন।

এই রোগে এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়াতে ৮২, থ্যাইল্যান্ডে ৪১ ও বাংলাদেশে ৪৬ জন মানুষ মারা গেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে ১৯ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছেন এক লাখ ২৪ হাজারেরও বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।