করোনাভাইরাস: ভারত থেকে আসছে না টিকা, চীন-রাশিয়ায় বিকল্প খুঁজছে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.04.20
ঢাকা
করোনাভাইরাস: ভারত থেকে আসছে না টিকা, চীন-রাশিয়ায় বিকল্প খুঁজছে সরকার ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এক রোগীকে করোনাভাইরাস টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেবার আগে শিশির গায়ে লেখা তথ্য যাচাই করে নিচ্ছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ৮ এপ্রিল ২০২১।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং ভারত থেকে টিকা সরবরাহ আটকে যাবার প্রেক্ষাপটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চীন ও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে সরকার। 

সোমবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সভায় ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে আট সদস্যের এই কমিটি গঠন করার কথা মঙ্গলবার বেনারকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। 

চীন সরকার বাংলাদেশকে পাঁচ লাখ টিকা উপহার দিতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, “এছাড়া চীনা কোম্পানি সিনোফার্ম বাংলাদেশের কাছে ৬০ লাখ টিকা বিক্রি করতে চায়। আমরা বলেছি, ৬০ লাখ কেন? আমরা আরও বেশি টিকা ক্রয় করতে চাই।” 

বাংলাদেশের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে জুনের ভেতর ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ টিকা দেবার কথা ছিল বলে জানান মন্ত্রী। এর মধ্যে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মিলে সেরাম পাঠিয়েছে মাত্র ৭০ লাখ। মার্চ-এপ্রিলে কোনো টিকা আসেনি। 

টিকার বাকি চালান কবে আসতে পারে সে বিষয়ে সেরাম ইন্সটিটিউট কিছুই “বলছে না” জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বিকল্প পথ বের করতে হবে। ভারত আমাদের টিকা না দিলে আমরা কি বসে থাকব?”

“চীন হোক, রাশিয়া হোক, আমেরিকা হোক, যেখান থেকে পারি আমরা টিকা সংগ্রহ করব,” বলেন তিনি। 

সেরাম থেকে আসা ৭০ লাখ টিকার বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত থেকে উপহার হিসেবে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা পাবার ফলে বাংলাদেশে টিকার মোট মজুদ ছিল এক কোটি তিন লাখ। 

গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে শুরু হয় গণটিকা কার্যক্রম, এর আট সপ্তাহ পরে এপ্রিল থেকে শুরু হয় টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সোমবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাস টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৭ লাখের বেশি মানুষ। দুটি করে ডোজ দিয়ে এই সংখ্যক মানুষের কোর্স সম্পন্ন করতে প্রয়োজন প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টিকা। 

সোমবার পর্যন্ত টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন দেড় লাখের বেশি মানুষ, পাশাপাশি নতুনদের প্রথম ডোজ দেওয়াও অব্যাহত রয়েছে। 

“আমরা টিকা কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে এখন একটি সমস্যার মধ্যে আছি। মজুদ টিকা দিয়ে এক মাস চলবে বলা যায়,” জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। 

‘একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা কেনা সঠিক ছিল না’ 

সম্ভাব্য বিকল্প টিকাগুলোর মধ্যে “চীনের সিনোফার্ম ও আনহুই জিফেই এবং রাশিয়ার স্পুটনিক টিকা,” কেনার ব্যাপারে সুপারিশ করা হতে পারে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান সরকার গঠিত কমিটির প্রধান ও ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান। 

তবে ব্যবহারের আগে ওই টিকাগুলোকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেতে হবে বলেও জানান তিনি। 

তাঁদের এই কমিটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত টিকাগুলোর কার্যকারিতা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ নিজ নিজ জাতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, বিভিন্ন ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল এবং কে কত দ্রুত টিকা সরবরাহ করতে পারবে সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে বলে জানান মাহবুবুর রহমান। 

তিনি বলেন, “সিনোফার্মের টিকা এপ্রিলের মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন লাভ করবে বলে আমাদের জানিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। আমাদের উদ্দেশ্য, তাড়াতাড়ি টিকা পাওয়া নিশ্চিত করা।” 

“চীনা সরকার আমাদের পাঁচ লাখ সিনোফার্মের টিকা উপহার হিসাবে দিতে চেয়েছে। আমরা ওষুধ প্রশাসন থেকে এ ব্যাপারে চীনা কর্তৃপক্ষকে অনাপত্তি পত্র দিয়ে দিয়েছি। খুব সহসাই টিকাগুলো বাংলাদেশে আসবে,” বলেন তিনি। 

গত বছর বাংলাদেশে করোনাভাইরাস টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল পরিচালনা করতে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক ও আনহুই জিফেই আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত সেই ট্রায়ালগুলো হয়নি। 

পরবর্তীতে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মার মাধ্যমে যুক্তরাজ্য-সুইডেন উদ্ভাবিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা কেনার চুক্তি করে সরকার। 

একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। 

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক ও আনহুই জিফেইকে বাংলাদেশে করোনা টিকার শেষ ধাপের ট্রায়ালের অনুমতি দিতে পারতাম। সেক্ষেত্রে, আমাদের টিকা প্রাপ্তি সহজ হতো।” 

তবে এই বক্তব্য নাকচ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে চীনা ও ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানি করোনাভাইরাস টিকার ট্রায়াল পরিচালনা করতে চায়। কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ কি গিনিপিগ? তাদের জীবনের কি দাম নেই?” 

তিনি বলেন, “তাঁরা নিজ দেশে টিকার ট্রায়াল পরিচালনা করুক। তাদের দেশেও তো করোনা রোগী ছিল।” 

বেড়েছে লকডাউন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউনের (বিধিনিষেধের) মেয়াদ একই শর্তে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। 

গত ১৪ এপ্রিল থেকে আটদিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়, ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বহাল থাকার কথা ছিল। 

এদিকে লকডাউনের মধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ দেশে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়েছে। 

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। তবে ঢাকা-কক্সবাজার-ঢাকা আকাশপথে আপাতত উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে বলেও জানান তিনি। 

এছাড়া বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত হলেও দেশে এসে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের জন্য চালু করা বিশেষ ফ্লাইট কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে সরকার। 

এদিকে রোববার ঢাকার মহাখালীতে এক হাজার শয্যার “ডিএনসিসি ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল” উদ্বোধন করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সেখানে সোমবার থেকে রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে। 

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হন গত বছরের ৮ মার্চ। এই রোগে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এর দশ দিন পর, ১৮ মার্চ। 

এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাত লাখ ২৭ হাজার ৭৮০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ও দশ হাজার ৫৮৮ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩০ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।