করোনাভাইরাস: পরিস্থিতির অবনতি হলে অক্সিজেনের চাহিদা মেটানো হবে ‘দুশ্চিন্তা’র বিষয়
2021.04.26
ঢাকা
ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে সোমবার থেকে স্থল সীমান্ত বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশে অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব উৎপাদনের বাইরে যে অক্সিজেন ভারত থেকে আমদানি করত তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে দৈনিক মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। তবে সোমবার পর্যন্ত দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করছে, তা পর্যাপ্ত বলেই মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া।
“ভারত থেকে গত কয়েকদিন অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ থাকার পরও আমাদের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ আছে তা চাহিদার তুলনায় এখন পর্যন্ত মোটামুটি পর্যাপ্ত,” বেনারকে বলেন ডা. ফরিদ হোসেন।
“তবে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে ঠিক কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে, তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা আছে,” বলে জানান তিনি।
তাঁর মতে, ভারতে করোনার যে ধরন (ভেরিয়েন্ট) আঘাত করেছে, সেটি খুবই খারাপ, সেটি যাতে আমাদের এখানে না আসে, সে বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা দুইশ টন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য দৈনিক মেডিকেল অক্সিজেন চাহিদা নির্ণায়ক ওয়েবসাইট পাথ এর হিসেব অনুযায়ী, সোমবার বাংলাদেশে মেডিকেলে অক্সিজেনের চাহিদা ছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭২০ কিউবিক মিটার বা ২৮০ টন। দৈনিক আক্রান্ত, মৃত্যু এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসেব প্রকাশ করে পাথ।
বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে দৈনিক ১৮০ টন বা ১ লাখ ২৬ হাজার কিউবিক মিটার মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশে লিমিটেড ও স্পেক্ট্রা অক্সিজেন। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের কাছ থেকেও অক্সিজেন নেয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার সায়িকা মাজেদ বেনারকে বলেন, গত এক বছরে দেশে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে তিনগুণ, গত কয়েক সপ্তাহে এই চাহিদা আরও বেড়েছে।
“বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে আমরা ইতিমধ্যে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছি। ভারত থেকে গত কয়েকদিন ধরে মেডিকেল অক্সিজেন আমদানিও বন্ধ রয়েছে,” বলেন সায়িকা মাজেদ।
ইসলাম অক্সিজেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাইন বিল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা আমাদের সক্ষমতার দিয়ে অক্সিজেন উৎপাদন করছি। কিন্তু পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হলেই এভাবে সরবরাহ অব্যাহত রাখা কঠিন হতে পারে।”
“এই পরিস্থিতিতে দ্রুত অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ভারতে প্রচুর মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তারা অক্সিজেন রপ্তানি করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া সর্বশেষ হিসেব বলছে, দেশের ২৩টি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে এখনো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ পদ্ধতির আওতায় আনতে পারেনি সরকার।
অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ফরিদ মিয়া বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করছে এবং খুব দ্রুত এই অবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
টিকার প্রথম ডোজ বন্ধ
মজুত কমে আসা এবং সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা না কাটায় সোমবার থেকে সারাদেশে সামায়িকভাবে করোনাভাইরাসের প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ করে শুধু দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়া চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। ওইদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আগামী মে মাসে জাতিসংঘের কোভ্যাক্স কর্মসূচি থেকে ফাইজার বায়োটেকের এক লাখ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
তিনি জানান, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট দেশটির রপ্তানিতে বাধার কারণে টিকা দিতে পারছে না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অন্তত ২০ লাখ টিকা আনার দ্রুত ব্যবস্থা করতে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে বলেছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে বাংলাদেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে সরকার। দেশে আসা এই টিকাগুলোর ৭০ লাখ বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এর মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে কেনা ও বাকি ৩৩ লাখ ভারত সরকারের কাছ থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া।
চুক্তিমতে জুনের মধ্যে সেরাম বাংলাদেশকে আরো দুই কোটি ৩০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করার কথা। কিন্তু মার্চ-এপ্রিলে কোনো টিকাই পাঠায়নি তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা দিয়েছেন ৫৮ লাখের বেশি মানুষ। দুটি করে ডোজ দিয়ে এদের কোর্স সম্পন্ন করতে মোট টিকার প্রয়োজন হবে এক কোটি ১৬ লাখের বেশি। অথচ সব মিলে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে টিকা এসেছে এক কোটি তিন লাখ।
সময়মতো টিকার চালান না আসলে প্রথম ডোজ দেওয়া ব্যক্তিদের ১৩ লাখের বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে পারবেন না।
প্রথম ডোজ দেবার ৮ সপ্তাহ পরে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেউ প্রথম ডোজ দেবার ১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ না দিলে তাঁর প্রথম ডোজ কোনো কাজে আসবে না।
“সরকার চীন থেকে টিকা আনার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এ দেশে প্রস্তুত করার জন্য সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া চীন সরকার ছয় লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে প্রদান করবে বলে জানিয়েছে,” বলেন ডা. রোবেদ।
ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ, বাড়ছে লকডাউন
গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করেই ভারতে বেড়ে গেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। গত তিন দিনে দেশটিতে শনাক্ত হয়েছেন দশ লাখেরে বেশি নতুন রোগী। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছে যা অধিকতর দ্রুততায় সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম।
এ অবস্থায় সোমবার থেকে ভারতের সাথে ১৪ দিনের জন্য স্থলপথে যাতায়াত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রোববার এই সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে এই সময় পণ্য আমদানি–রপ্তানি চলবে।
এছাড়া গত ১৪ এপ্রিল থেকে ভারতরে সঙ্গে আকাশপথে যাত্রী চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান লকডাউনের বিধিনিষেধ আরো এক সপ্তাহ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। ৫ মে পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বলবত থাকবে।
তবে এ সময় দোকানপাট ও শপিংমল সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চালু থাকবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া সংক্রমণ ঠেকাতে এবারের ঈদুল ফিতরের নামাজ ঈদগাহ বা খোলা জায়গার পরিবর্তে মসজিদে আদায়ের অনুরোধ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সোমবার এক আদেশে এ কথা বলা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সাত লাখ, ৪৮ হাজার ৬২৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ১১ হাজার ১৫০ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন এক কোটি ৭৩ লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন এক লাখ লাখ ৯৫ হাজারের বেশি।
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ কোটি ৭৪ লাখ ১২ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ৩১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি।