করোনাভাইরাস: চিকিৎসা পেতে গর্ভবতী মায়েদের ভোগান্তি

পুলক ঘটক
2020.05.27
ঢাকা
200527_Pregnant_mother_1000.JPG ঢাকার খিলগাঁও স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে একটি শিশুর করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ১২ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

গর্ভবতী মায়েরা রাজধানীর বেশিরভাগ হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কোভিড চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে মাত্র দুটিতে গর্ভবতীরা চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

“কুর্মিটোলা জেনারেলসহ প্রায় সবগুলো করোনা হাসপাতাল নানা অজুহাত দেখিয়ে গর্ভবতী মায়েদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমরা প্রয়োজনে তাদের চিকিৎসক এবং ধাত্রী দিতে চেয়েছি। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি,” বেনারকে জানান দেশের প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশন আরা বেগম।

“রোগী ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলো প্রথম থেকেই ঘটেছে। গর্ভবতী মায়েদের এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যেতে হচ্ছে,” বেনারকে বলেন গাইনি চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গায়নোকোলিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী।

বাংলাদেশে মহামারি করোনার সময়ে ৯ মাসে আনুমানিক ২৪ লাখ শিশুর জন্ম হবে জানিয়ে গত ৭ মে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রসূতি মা ও নবজাতকদের রূঢ় বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘন্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৪১ জন, মারা গেছেন ২২ জন।

এ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট মারা গেছেন ৫৪৪ জন ও আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮ হাজার ২৯২ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, বুধবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬ লাখ ৫১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন তিন লাখ ৫৩ হাজারের বেশি।

‘আগে করোনা পরীক্ষা পরে প্রসূতি সেবা’

ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ইমরান হোসেন বেনারকে জানান, গত ২৪ মে ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকার তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে গেছেন। গর্ভবতী ওই নারীর রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যায়।

“কিন্তু কোভিড পরীক্ষার প্রতিবেদন ছাড়া কোনো হাসপাতালই রোগীকে ভর্তি করেনি। সর্বশেষ পান্থপথের একটি হাসপাতাল রোগীকে ভর্তি নেয়, কিন্তু ততক্ষণে ওই মা ঘুরে ঘুরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন,” জানান ইমরান।

করোনার জন্য সরকার ঢাকায় ১২টি হাসপাতালকে নির্দিষ্ট করলেও শুধুমাত্র মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গর্ভবতী মায়েদের ভর্তি নিচ্ছে।

“করোনার লক্ষণ দেখলেই গর্ভবতী নারীদের ভর্তি না নিয়ে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে প্রায় সব হাসপাতাল। তাই এটা সামাল দেয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ছে,” বেনারকে বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নিলুফার সুলতানা।

করোনার জন্য প্রথম থেকে নির্ধারিত কুর্মিটোলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাইনি ডাক্তার থাকলেও সেখানে চিকিৎসা পাচ্ছেন না প্রসূতিরা।

এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ বেনারকে বলেন, “করোনা রোগীর সেবা দিতে আমাদের তিনটি ইউনিটে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে আমাদের জনবল তিন ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। তাই মেটার্নিটি সার্ভস বন্ধ করতে হয়েছে।”

এসব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালক ডা. মো. আমিনুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “প্রথম দিকে মেডিকেলগুলোর জানা ও বোঝার ঘাটতি ছিল। তাই এ রকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে এখন জরুরি রোগী ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ কমে গেছে।”

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এক ডজনেরও বেশি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করে দেয় সরকার। ফলে ওই সব হাসপাতালে অন্য রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা।

এই প্রেক্ষাপটে সরকার কোভিড হাসপাতালে নন কোভিড রোগী ভর্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ফলে একই হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের আলাদাভাবে চিকিৎসা দিতে হবে।

এই নিদের্শনা গত ২৪ মে দেশের সব হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, এই নির্দেশ দু-একদিনের মধ্যে কার্যকর হয়ে যাবে।

“সন্তান সম্ভবা হওয়ার পর অন্তত চারবার চেকআপ করা নিয়ম। চারবার আল্টাসনোগ্রাম করতে হয়। এগুলো এখন বন্ধ। টেলিফোনে পরামর্শ দেই। তবে জরুরি অবস্থায় যারা আসে তাদের ফিরিয়ে দেই না,” বেনারকে বলেছেন কুমুদিনি মহিলা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বিলকিস বেগম চৌধুরী।

গত দুই সপ্তাহে নগরীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে অন্তত নয়টি অপারেশন করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জরুরি অবস্থায় রোগীর করোনা আছে কি-না ভাবার অবকাশ থাকে না।”

সীমিত আকারে খুলছে অফিস-আদালত

একদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার ৩০ মে’র পর থেকে সীমিত আকারে অফিস-আদালত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে গণপরিবহন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বেনারকে বলেছেন, “নাগরিক জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করা হবে। এ জন্য অফিস-আদালত সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।”

“সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ ব্যবস্থায় সীমিত আকারে খুলতে পারবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরাসহ ১৩ দফা স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে,” জানান প্রতিমন্ত্রী।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বেনারকে বলেন, “লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্বের প্রচেষ্টা কিছুটা কাজে এসেছে, সার্বিকভাবে হয়নি। ভাইরাসটি সামাজিক বিস্তার লাভ করেছে। এই অবস্থায় সব কিছু খুলে দেয়া হচ্ছে। তার মানে আমাদের এখন করোনা সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে, যতদিন না ভাইরাসের প্রতিষেধক বাজারে আসে।”

“সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে এবং আমাদের বাস্তবতায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাপ কতটুকু সামাল দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় আছে। আমাদের এবার সবচেয়ে খারাপ অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে,” মনে করেন তিনি।

করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। সাত দফায় সাধারণ ছুটি ৩০ মে বাড়ানো হয়।

এবার ৩১ মে থেকে সীমিত আকারে অফিস-আদালত খুলে দেবার কথা জানালেন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।

হাসপাতালে আগুন: মৃত পাঁচজনের তিনজন করোনা রোগী

বুধবার রাত দশটার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আকস্মিক এক অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন নিহত হয়েছেন বলে ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানায় রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা বাসস।

নিহত চার পুরুষ ও এক নারীর মধ্যে তিনজন লাইফ সাপোর্টে থাকা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ছিলেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, হাসপাতালের এসি বিস্ফোরণ থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে, জানায় ফায়ারা ব্রিগেড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।