তৈরি পোশাক খাতের নিরপাত্তা: চলে গেলো অ্যাকর্ড, দায়িত্বে নবগঠিত জাতীয় সংস্থা

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.06.01
ঢাকা
200601_Accord_RSC_1000.JPG বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে ঢাকার পোস্তগোলা সেতুর কাছে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ। ২০ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিল তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে গঠিত ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড, যারা দেশের এক হাজার ২০০ তৈরি পোশাক কারখানার পরিবেশ নিরাপদ করতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে।

সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম নবগঠিত জাতীয় সংস্থা তৈরি পোশাক স্থায়ী কাউন্সিলের (দ্য আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল—আরএসসি) কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে অ্যাকর্ড।

তৈরি পোশাক শিল্পের নেতারা বলছেন, আরএসসি গঠন একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ডের সকল কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে।

অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড কী?

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলে সাভারের রানাপ্লাজা ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় সেখানকার তৈরি পোশাক কারখানার এক হাজার একশ’র বেশি কর্মী নিহত হলে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়ে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে থেকে তৈরি পোশাক না কিনতে সেখানকার ট্রেড ইউনিয়নের তোপের মুখে পড়ে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো। বাংলাদেশে কর্ম-পরিবেশ উন্নত করতে ইউরোপীয় ক্রেতারা গঠন করে অ্যাকর্ড নামে একটি সংস্থা। আর আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর উদ্যোগে গঠিত হয় অ্যালায়েন্স নামক সংগঠন।

এই দুই সংগঠনের কাজ ছিল, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সেগুলো নিরাপদ করতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেসব বিষয়ে সুপারিশ করা। কোনও কারখানা তাদের কথামতো ব্যবস্থা না নিলে তাদের পণ্য কিনতে অপারগতা প্রকাশ করত ক্রেতারা।

পাঁচ বছরের জন্য এই দুই সংগঠন বাংলাদেশে কাজ করার জন্য চুক্তি করে। ২০১৮ সালে অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। কিন্তু অ্যাকর্ড আরও থাকতে চাইলে সরকার ও কারখানা মালিকদের সাথে সমস্যার সৃষ্টি হয়।

অ্যালায়েন্সের দাবি, তাদের আরও থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। সরকারের প্রস্তাব ছিল, তারা অ্যাকর্ডের কাজগুলো আরসিসি নামক একটি কমিটির মাধ্যমে নিজেরাই করবে।

সুরাহার জন্য বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত কয়েক দফা সময় বৃদ্ধির পর আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকার, কারখানা মালিক ও অ্যাকর্ডকে সময় দেয়।

পরে আলোচনার মাধ্যমে আরসিসি’র পরিবর্তে আরএসসি নামক একটি সংস্থা গঠন করে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে রাজি হয় অ্যাকর্ড। সেই অনুসারে ২০২০ সালের মে মাসের শেষ পর্যন্ত সময় দেয় আদালত।

সোমবার আরএসসি–কে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে দায়িত্ব শেষ করে অ্যাকর্ড। ১৮-সদস্যের আরএসসিতে ক্রেতা, কারখানা মালিক এবং ট্রেড ইউনিয়নের ছয়জন করে প্রতিনিধি রয়েছেন।

সোমবার আরএসসির যৌথ বিবৃতিতে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট এবং আরএসসি পরিচালক রুবানা হক বলেন, “আরএসসি একটি নজিরবিহীন উদ্যোগ। ব্র্যান্ড এবং ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সহায়তায় সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাকে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিরাপদ করা হবে, যাতে ক্রেতারা এ দেশ থেকে নির্দ্বিধায় পণ্য কিনতে পারে।”

সুইডিস ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং আরএসসিতে ব্র্যান্ড প্রতিনিধি রজার হুবার্ট বিবৃতিতে বলেন, “আরএসসি গঠনের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়নের সাথে অ্যাকর্ড যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করতে পারবে ব্র্যান্ডগুলো। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের সরবরাহ চেইনে নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা প্রদান করছে আরএসসি।”

আরসিসিতে ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি এবং ইন্ডাস্ট্রিয়া-অল বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চায়না রহমান বলেন, “বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সহযোগীদের সহায়তায় তৈরি পোশাক কারখানার কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়তা করব এবং তাঁদের নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ সংক্রান্ত উদ্বেগ নিরসন এবং কর্মীদের নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ অধিকার নিশ্চিত করতে তাঁরা যাতে কাজ করতে পারেন সেব্যাপার কাজ করে যাব।”

শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের সাবেক মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মদ বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ কর্মীদের জন্য নিরাপদ করতে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড যখন বাংলাদেশে আসে, তখন আমি মূলত সরকারের পক্ষে কাজগুলো করি।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কারখানাগুলোর পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই খারাপ ছিল এটা সত্য। কারখানার মালিকেরা কারখানার আধুনিকায়নে অনেক সময় বিনিয়োগ করতে চাইতেন না। রানা প্লাজার ধসের ঘটনায় বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হয়। এরপর ক্রেতাদের কাছ থেকে আমাদের ওপর বিরাট চাপ আসে।”

সৈয়দ আহম্মদ বলেন, “যে কাজটি সরকার বারবার বলেও কারখানার মালিকদের দিয়ে করাতে পারেনি, অ্যালায়েন্স এবং অ্যাকর্ড আসার ফলে কারখানা মালিকেরা সেই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।”

তিনি বলেন, “কারণ অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডের কথা না শুনলে তাঁদের বাজার হারাতে হতো। ফলে বর্তমানে আমাদের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো অনেক বেশি নিরাপদ। নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক কারখানা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম। আর এই অর্জনের পেছনে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডের অনেক অবদান আছে।”

সৈয়দ আহম্মদ বলেন, “অ্যালায়েন্স আগেই চলে গেছে। আর অ্যাকর্ড আজকে চলে গেলো। তবে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড যে কাজগুলো শেষ করতে পারেনি আমাদের উচিত সেই অসম্পূর্ণ কাজগুলো সমাপ্ত করা।”

আরএসসি ওই বিবৃতিতে বাংলাদেশের সকল তৈরি পোশাক কারখানায় করোনাভাইরাস থেকে কর্মীদের রক্ষা করতে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানানো হয়।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন বিদেশি ক্রেতারা। ফলে কঠিন সময় পার করছে দেশের প্রধান এই রপ্তানিমুখী শিল্প।

সোমবার পর্যন্ত তিনশ কোটি ডলারের বেশি (৩.১৮ বিলিয়ন ডলার) রপ্তানি বাতিল বা স্থগিত হয়ে গেছে বলে জানানো হয় বিজিএমইএ’র ওয়েবসাইটে।

এর ফলে ১১৫০টি কারখানায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ।

বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, দেশের তৈরি পোশাক খাতে ৪১ লক্ষ কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। যার মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ হাজার ৫৩৪ জন, মারা গেছেন ৬৭২ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ লাখ ২৯ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন তিন লাখ ৭৩ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।