করোনাভাইরাস: চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে রোহিঙ্গাদের ভয়

সুনীল বড়ুয়া ও কামরান রেজা চৌধুরী
2020.06.05
কক্সবাজার ও ঢাকা
200605_rohingya_Reluctant-1000.jpg কক্সবাজারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্র সৈকতের এই হোটেলটিতে ২০০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট তৈরি করা হচ্ছ। হোটেলটি পরিদর্শন করছেন জেলা প্রশাসন ও আন্তজার্তিক সংস্থার কর্মকর্তারা। ২ জুন ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাস আতঙ্কে জ্বর, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন সমস্যা লুকিয়ে রাখছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে শরণার্থী শিবিরের মধ্যে থাকা দোকান থেকে ওষুধ কিনে ঘরে থেকে চিকিৎসা করছেন তাঁরা। করোনাভাইরাস পরীক্ষাও করাতে চাইছেন না অনেকে।

তাঁদের ভয়, করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ইতিবাচক হলে রোগীসহ পরিবারের সকল সদস্যকে হাসপাতালে আলাদা করে রাখা হবে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কমপক্ষে দুজন রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছেন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সমস্যা লুকিয়ে রাখলে ভাইরাসের বিস্তার ঘটবে। এর ফলাফল মারাত্মক হতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ছাড়িয়ে তা পুরো কক্সবাজারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনা করে কক্সবাজার জেলাকে রেড জোন অর্থাৎ লাল অঞ্চল ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

সরকারি হিসাবে, বর্তমানে এই জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৮৮৭। এর মধ্যে ২৯ জন রোহিঙ্গা। একজন রোহিঙ্গা কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

উখিয়ার ক্যাম্প-২ (পূর্ব) এর রোহিঙ্গা নেতা মো. নূর বেনারকে বলেন, “মূলত দুইটি কারণে রোহিঙ্গারা করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলেও ভয়ে প্রকাশ করছেন না। প্রথমত হচ্ছে, শনাক্ত হওয়ার পর বসতঘর লকডাউন করা হচ্ছে। আবার পরিবারের অন্য সদস্যদের হাসপাতালের নির্জন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেকে যেতে আপত্তি জানাচ্ছেন।”

তিনি বলেন, “আবার আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের সবাই বাঁকা চোখে দেখে থাকে।”

মো. নূর বলেন, “আমার জানা মতে, রোহিঙ্গা শিবিরে বর্তমানে অসংখ্য মানুষের জ্বর, সর্দি-কাশি দেখা দিলেও তারা ভয়ে প্রকাশ করছে না, তারা চিকিৎসা কেন্দ্রেও যাচ্ছে না। অনেকে নিজে নিজে দোকান থেকে ওষুধ কিনে সেবন করছে।”

রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির সভাপতি মো. সিরাজুল মোস্তফা বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সচেতন করে যাচ্ছি। তবুও নির্জনকেন্দ্রে যেতে চাচ্ছে না তারা; রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে না। অনেকে মনে করছে সেখানে গেলে ভালো চিকিৎসা পাবে না, মারা যাবে।”

তিনি বলেন, “যে কারণে অনেকের সর্দি-কাশি, জ্বরসহ নানা অসুস্থতা দেখা দিলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের ভাসানচরে পাঠানো হবে, এমন ধারণাও আছে অনেক রোহিঙ্গার মধ্যে।”

তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান বেনারকে বলেন, “যারা কক্সবাজার থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে সাগরে আটকা পড়ে তাদের মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের কিছু বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা বার বার করে বলেছি, আমরা কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ভাসানচরে পাঠাব না।”

এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর আইসোলেশন কেন্দ্র থেকে পালিয়েছেন দুজন। তাদের একজন মো. আবছার (২৬) অ্যাম্বুলেন্স থেকে পালিয়ে গেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসু দ্দৌজা নয়ন।”

তিনি বলেন, “ঈদুল ফিতরের কয়েকদিন আগে করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান মো. আলমের ছেলে মো. আবছার। সন্দেহ হলে চিকিৎসকেরা তাঁর নমুনা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষায় তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে জেনে তিনি লুকিয়ে ছিলেন।”

নয়ন বলেন, “পরে তাঁকে খুঁজে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে করে আইসোলেশন সেন্টারে নেওয়ার সময় তিনি পালিয়ে যান।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক আছে। আমরা চেষ্টা করছি সেই আতঙ্ক থেকে তাঁদের বের করে আনতে।”

বাবা মো. আলমের দাবি, তাঁর ছেলে আবছার সুস্থ আছেন। ছেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। পরিবারের অন্য পাঁচ সদস্যও এখন পর্যন্ত সুস্থ।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা এম আর এইচ ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাসহ আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সংস্পর্শে আসায় এ পর্যন্ত ৮০১জন রোহিঙ্গাকে নির্জনকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

“এদের মধ্যে কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় ৬২৮ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৭৩ জন এখনও বিভিন্ন নির্জন কেন্দ্রে আছেন,” জানান ডা. তোহা।

মো. সামশু দ্দৌজা নয়ন জানান, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য এক হাজার ৯০০ শয্যার চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৬০০ শয্যার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৬০০ শয্যার কাজ দ্রুত শেষ হবে।

তিনি বলেন, নির্জনকেন্দ্রে নেয়া ছাড়াও যেসব এলাকায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে, ওইসব এলাকার ৩৬শ’ বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।

প্রথম ‘লাল অঞ্চল’ কক্সবাজার

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে দেশে প্রথমবারের মতো কক্সবাজার সদরের ১২ ওয়ার্ডকে লাল অঞ্চলের আওতায় আনা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন।

শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে টানা ১৪ দিনের জন্য এই লাল অঞ্চলে কঠোরভাবে ‘লকডাউন’ চলবে।

আগামী ২০ জুন রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত ওই এলাকাজুড়ে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করা হবে।

লকডাউনের মধ্যে সব ধরনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক গণজমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সকল জনসাধারণকে আবশ্যই নিজ নিজ আবাসস্থলে অবস্থান করতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৯১ জন, মারা গেছেন ৮১১ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন তিন লাখ ৯৩ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।