গণপরিবহন আংশিক চালু হলেও বেকার ৫০ লাখ শ্রমিক

শরীফ খিয়াম
2020.06.08
ঢাকা
200608_Corona-Transport_sector_1000.JPG করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ঢাকার গাবতলী এলাকায় বাসে ওঠানোর আগে এক যাত্রীর জুতায় জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন এক পরিবহন সহকারী। ১ জুন ২০২০।
[বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দুই মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর গত সপ্তাহে গণপরিবহন চালু হয়েছে। কিন্তু এখনো কর্মহীন রয়েছেন এই খাতের কমপক্ষে ৫০ লাখ শ্রমিক।

“সারা দেশে সব মিলিয়ে ১৮ থেকে ২০ লাখ শ্রমিক কাজে ফিরতে পেরেছে। বাকিদের আয়–উপার্জন না থাকায় অমানবিক জীবনযাপন করছে,” সোমবার বেনারকে বলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী।

ওই শ্রমিক নেতার দাবি, মাত্র ৩০ শতাংশ গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছেন মালিকেরা। বিশেষ করে বিভিন্ন আন্তঃজেলা রুটে তাঁরা গাড়ি চালাতেই চাচ্ছেন না। যে কারণে কাজে ফেরার সুযোগ হয়নি বিপুল সংখ্যক চালক, সহকারী বা সুপারভাইজারের।

পাশাপাশি কয়েক লাখ মেকানিক, গ্যারেজ মিস্ত্রী এবং বডি মিস্ত্রীও বেকার রয়েছেন বলে উল্লেখ করেন ওসমান। তিনি জানান, দেশে মোট পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বেনারকে বলেন, “এত কম সংখ্যক বাস চালিয়ে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। একজন মালিকও এখন লাভে নেই।”

“মূলত শ্রমিক আর যাত্রীদের কথা চিন্তা করেই এই দুর্দিনে আমরা বাস চালু রেখেছি। সব চালক, সহকারী বা সুপারভাইজার পালা করে ‌ট্রিপ দিচ্ছে। যাতে তারা সবাই কম-বেশি আয়ের সুযোগ পায়,” বলেন তিনি।

গত ১ জুন থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গণপরিবহনের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে কম যাত্রী নিয়ে চলাচল শুরু করে নগর পরিবহন ও দূরপাল্লার বাসগুলো।

তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি, করোনাভাইরাসের ভয়ে অতি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। যারা বের হচ্ছেন তাঁরাও আবার খুব না ঠেকলে গণপরিবহন ব্যবহার করছেন না। যে কারণে বেশি ভাড়া আদায় করেও লাভ হচ্ছে না।

রাজধানীর শ্যামলী বাস স্টপেজে মিরপুর-আজিমপুর রুটে চলাচলকারী নগর পরিবহন মেট্রো সার্ভিসের চালক মোহাম্মদ বাচ্চু বেনারকে বলেন, ‍“‍প্রতি ট্রিপে যা আয় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি টাকার তেলই পুড়ছে।”

দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী এমএম পরিবহনের গাবতলী টার্মিনালের কাউন্টার মাস্টার মিজানুর রহমান মিজান বেনারকে জানান, “বাস চলাচল শুরু হওয়ার পর ঢাকার বাইরে থেকে প্রতি ট্রিপে কমবেশি যাত্রী এলেও এখান থেকে যাওয়ার মতো যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না।

“চল্লিশ সিটের গাড়িতে আমরা এখন ২০ জন করে যাত্রী নিচ্ছি। তাও সব ট্রিপে যাত্রী হচ্ছে না," বলেন তিনি।

পরিবহন মালিক নেতা এনায়েত বেনারকে বলেন, ‍“কোথাও কোথাও প্রতি ট্রিপে মাত্র দুই–তিনজন যাত্রী হচ্ছে।” শ্রমিক নেতা ওসমান জানান, এ ক্ষেত্রে ক্ষতিটা মালিকদের হলেও শ্রমিকেরা তার প্রভাব এড়াতে পারছেন না।

“অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, দূরপাল্লার এক ট্রিপে আয় হয়েছে দুই হাজার টাকা, কিন্তু বাসের শ্রমিকদের বেতন আড়াই হাজার টাকা। তখন তাদের পারিশ্রমিকটা বকেয়া থেকে যায়,” বলেন তিনি।

বেকার শ্রমিকদের কী হবে?

বেকার পরিবহন শ্রমিকদের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কথা জানান ওসমান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানকে তাঁরা বিষয়টি জানিয়েছেন।

“আমরা বলেছি, শ্রমিকদের আর্থিক প্রণোদনা এবং রেশনের চাল না দেওয়া হলে পরিবহন খাত অচল হয়ে পড়বে,” জানান ওসমান।

সরকারিভাবে প্রত্যেক শ্রমিককে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা পায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে সোমবার এক ভিডিও বার্তায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী জানান, দূরপাল্লায় অভিযোগ না থাকলেও শহর এলাকায় বেশি ভাড়া নেওয়ার কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। মালিক-শ্রমিকদের পাশাপাশি যাত্রীদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

এর আগে গত শনিবার পরিবহন শ্রমিকদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সরবরাহ, চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। কোনো শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হলে তার উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত, মৃত্যু হলে পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া, শ্রমিকদের ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ এবং সবাইকে নিয়োগপত্র দেওয়ার দাবি জানায় ফেডারেশন।

“শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে চারশ কোটি টাকার পড়ে থাকলেও এই ক্রান্তিকালেও তা পরিবহন শ্রমিকদের কোনো কাজে আসছে না শুধুমাত্র নিয়োগপত্র না থাকার কারণে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠনের পরিকল্পনাও আটকে আছে,” বেনারকে বলেন ওসমান।

করোনার উপসর্গ নিয়ে শ্রমিক নেতার মৃত্যু

ঢাকা মহানগর সড়ক পরিহন শ্রমিক ইউনিয়নের শীর্ষনেতা ছিলেন মুজিবর রহমান খান। করোনার উপসর্গ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন তিনি।

‍প্রয়াতের মেয়ে মাহফুজা আক্তার তিশা বেনারকে বলেন, ‍“চার-পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখাত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল গিয়েও ‌নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) পাইনি।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক বেনারকে বলেন, ‍“বিশেষ নজর দেওয়া না হলে পরিবহন শ্রমিকেরা করোনাভাইরাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বাহক হয়ে উঠবেন। তাঁদের মাধ্যমে খুব দ্রুত প্রচুর মানুষ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

সারা দেশে ৪২ জনের মৃত্যু

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে গত ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে করোনাভাইরাসে আরও ৪২ জনের মৃত্যু ঘটেছে, নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৭৩৫ জন।

এ নিয়ে সোমবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫০৪ জনে, মারা গেছেন ৯৩০ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ চার হাজারের বেশি।

করোনার সংক্রমণ রোধে সচেতনতা তৈরি করতে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে জোর প্রচারণা চালাতে সোমবার জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ জানিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।